banner

বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 847 বার পঠিত

 

আসুন, তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেই আপনাদের সাথে


জিয়াউল হক


তাঁর বয়স বিরাশি বৎসর। তিনি পক্ষাঘাতগ্রস্থ হয়ে আজ প্রায় চারটি বৎসর ধরে শয্যাশায়ী। নিজের শোবার ঘর, নিজের খাটটাই হলো তাঁর পৃথিবী। শরীরের একটা পাশ পুরোপুরি অচল। দেখতে পারেন, কথাও বলতে আর বুঝতে, বুঝাতেও পারেন, তবে একটু আধটু আড়ষ্ঠতা আছে, যথেষ্ঠ স্লোও বটে।
বিছানায় পড়ে থাকলেও তিনি সবার খোঁজ নিতে চান, জানতে চান কে কোথায় এবং কেমন আছে? বুড়ো বুড়িরা আবার এতসব জানতে চাইবেন কেন? এটাই তো আমাদের অধিকাংশদের ধারনা। তারা বসে বসে আল্লাহ আল্লাহ করবেন, সংসারের এত খোঁজ রেখে তাদের কি লাভ?
আমরা কি ভাবি যে, এই সংসার আর পরিবার নামের যে জিনিসটা নিয়ে আমরা এত বেশি তৎপর, তা কিন্তু এই বুড়ো-বুড়িরাই গড়েছেন। নিজের হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান নিয়ে কার না আগ্রহ থাকে! সংসারে বাস্তব-অবাস্তব নানা ব্যস্ততার কারণে অনেকেই তাঁর কথা ততটা মনোযোগ দিয়ে শুনতে না চাইলেও আমি শুনি তাঁর কথা। মন দিয়ে শুনি।
তিনি এক নাগাড়ে বলে যান, আমি বসে বসে শুনি। মাঝে মাঝে হাঁপিয়ে গেলে তিনি চোখ মুদে বসে একটু জিরিয়ে নেন। তখন তার মুখ পানে চেয়ে থাকি। একদিন তাঁর ঐ মুখটা সজিব ছিল, ভরাট ও প্রাণবন্ত ছিল। নিজের চোখেই তো সেটা দেখেছি। আজ সে জৌলুস নেই, সেই লাবন্য নেই, চামড়া ঝুলে গেছে মুখের। কিন্তু আমি যেন সেখানেই এক অবর্ণনীয় লাবণ্য দেখি, চুপ করে চেয়ে চেয়ে দেখি আর শিহরিত হই।
অনেক সময় তাঁর কথাগুলো অসংলগ্ন হয়ে যায়। তিনি একই কথা বার বার বলেন। সম্মুখে বসে থাকাদের কেউ কেউ বিরক্ত হন। ইশারায় বারণ করি, তা প্রকাশ করতে। আমি বরং সে সময় তাঁর দিকে অতিমাত্রায় মনোযোগ দেই। অন্তত তাকে তেমনটাই বুঝতে দেই যে, তার কথাগুলো মন দিয়ে শুনছি। তিনি খুশি হন। একজন মনোযোগী শ্রোতা পেয়ে তিনি বলে চলেন। বসে বসে শুনি, তন্ময় হয়ে শুনি আর চেষ্টা করি, তিনি যা বলছেন তা বুঝে উঠতে। সে সাথে সেটাও বা সেটুকুও বুঝার চেস্টা করি, যেটা তিনি বলছেন না বা বলতে পারছেন না।
সেদিনও তার সামনে বসে বসে সময় কাটাচ্ছিলাম। তাঁর কথা শুনছিলাম। তিনি আতংকিত, কারণ, সুরা ইয়াসিনটা তাঁর পুরোটাই মুখস্থ ছিল, ইদানিং কেন যেন সেটা তিনি পুরোটা মনে করতে পারছেন না। ভুল হয়ে যাচ্ছে। তিনি চাইছেন, স্মৃতি থেকে মুখস্থ বলে যাবেন আর আমি শুনে দেখবো, ঠিক আছে কিনা, সেটা। বললাম, জি। আপনি বলতে থাকেন, আমি শুনছি।
তিনি আড়ষ্ঠ কন্ঠে তেলওয়াত করে চলেছেন সুরা ইয়াসিন। কখনও কখনও একটু থেমে আবার শুরু করেন। ঘাড় দুলিয়ে, মাথা হেলিয়ে বিরাশি বৎসরের এক বুড়ি সুরা ইয়াসিন শোনাচ্ছেন। প্রথম মুবিন পর্যন্ত এসে চোখ খুলে জানতে চাইলেন ঠিক আছে তো? বললাম; জি। ঠিক আছে, কোথাও ভুল হয়নি। তিনি খুশি হলেন। তার চোখ মুখ উজ্জল হয়ে উঠলো।
আবার শুরু করলেন; ওয়াদ্বরিব লাহুম মাসালান আসহাবাল ক্বারিয়া—। তিনি তেলওয়াত করে চলেছেন, আমি বসে বসে শুনছি। দ্বিতীয় মুবিনও শেষ করলেন। জানতে চাইলেন একইভাবে, ঠিক আছে তো? বললাম; জি। ঠিক আছে। তিনি আবারও শুরু করলেন; ——।
ঘরে আর কেউ নেই। তিনি খাটের উপরে বসে আছেন, আমি পাশেই এক কোণে বসে বসে তাঁর তেলাওয়াত শুনছি। মাঝখানে একবার আটকে গেলেও নিজে থেকেই আবার শুধরে নিয়ে তিনি তৃতীয় মুবিন পর্যন্ত শেষ করে চোখ খুললেন। আমার দিকে চেয়ে জানতে চাইলেন, ঠিক আছে তো । বললাম; জি। ঠিক আছে।
তিনি বললেন, দেখলে তো? ঐ যে একবার ঠেকে গিয়েছিলাম, এরকম মাঝে মাঝে ভুল হয়ে যায়। বললাম, ও রকম সবারই হয়। আপনি এ বয়সে অসুস্থ শরীর নিয়ে মনে রাখতে পেরেছেন! আলহামদুলিল্লাহ। তিনি নিজেও কন্ঠ মেলালেন, আলহামদুলিল্লাহ। তার চেহারার উজ্জলতা যেন আরও বেড়ে গেল নিমেষেই।
তিনি আবার ডায়াবেটিকসের রুগীও বটে। গলা শুকিয়ে যায় ঘন ঘন, পানি খেতে হয়। একটু পানি চাইলেন, মুখে তুলে দিতে চাইলাম কিন্তু তিনি হাত বাড়িয়ে দিয়ে নিজের হাতে গ্লাসটা নিলেন, এর পরে ধীরে ধীরে দু’ঢোক গিলে তা আবার আমার দিকেই ফেরত দিলেন। গ্লাসটা নিয়ে পাশের লকারের উপরে রেখে দিলাম।
তিনি একটুখানি থেমে আবারও শুরু করলেন। কোথায় যেন ছিলেন? মনে করতে পারছিলেন না। বললাম তৃতীয় মুবিন শেষ করেছেন। তৃতীয় মুবিনের পরে কোথা হতে শুরু হবে, সেটা তার মনে নেই। ধরিয়ে দিলাম; ওয়াইয়াকুলুনা মাতা হাজাল ওয়াদু ইন কুনতুম সদিক্বিন-।
তিনি ধরলেন এবং আবার শুরু করলেন। কিন্তু সামান্য কিছুদুর এগিয়ে থেমে গেলেন। ওয়ানুফিখা ফিসসুরি পর্যন্ত গিয়ে আর মনেই করতে পারলেন না। বার বার তাকে মনে করিয়ে দেবার চেষ্টা করলাম, সেখান থেকে ধরে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করলেন কিন্তু আটকে গেলেন আবারও।
তিনি বিব্রত হলেন, কষ্ট পেলেন। তার চোখের কোণে জমে উঠলো অশ্রু। কষ্ট পেলাম। শান্তনা দেবার চেষ্টা করলাম, বললাম; বয়স হলে এরকম হয়। কিন্তু তাতেও তার মনটা শান্ত হচ্ছে না। আক্ষেপ করতে করতে সচল থাকা হাতটা তুললেন, দুআ করার জন্য। দুআর শুরু করে দিলেন।
তিনি দুআ করে চলছেন; হে আল্লাহ, আমার অক্ষমতা মাফ করে দিও। মনে মনে বললাম; আমিন।

তিনি বলে চলেছেন; হে আল্লাহ যতদিন বাঁচি, যতক্ষণ বাঁচি, তোমার স্বরণটা যেন না ভুলে যাই, তোমার অবাধ্য যেন না হই। বললাম; আমিন।

তিনি যখন দুআ করতে ব্যস্ত, তখন তাঁর অচল হাতটি বালিশের উপর থেকে গড়িয়ে বিছানায় ঢলে পড়লো, সেটাকে আবার যথাস্থানে বালিশের উপরে তুলে দিলাম। সেদিকে তার খেয়াল নেই, তিনি দুআতে ব্যস্ত।
“হে আল্লাহ আমার সন্তানেরা যে যেখানে আছে, সবাইকে সুস্থ রাখো, ভালো রাখো। বললাম; আমিন।”

তিনি বলে চলেছেন; “হে আল্লাহ, যত বিপদ আপদ দিতে চাও আমার উপরেই দাও। আমার পাঁচ সন্তানের উপরে কোন বিপদ আপদ দিও না!”

আমার চোখ ভিজে এলো। চলৎশক্তি হারিয়েছেন তিনি। ব্লাডপ্রেশার, আর্থাইটিস, চোখের সমস্যা, স্ট্রোক, ডায়াবেটিস এরকম কত অসুখ তার! আজ চারটি বৎসর শয্যাশায়ী, নিজের কাজটুকুও কারো সহযোগীতা ছাড়া করতে পারেন না, অথচ তিনি আরও অসুখ, আর বিপদ চাইছেন আল্লাহর কাছে তাঁর পাঁচ সন্তানের সুস্থতার বিনিময়ে!
আমার চোখ দিয়ে তপ্ত অশ্রু গড়িয়ে পড়লো তাঁর অলক্ষ্যেই। এবারে আমিন না বলতে পেরে নিজের হাতটাই তুললাম এই মহীয়সী নারীর সাথে তাঁর দুআতে অংশ নিতে।
বলে উঠলাম; “রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বাইয়ানি ছগিরা।”

আর হ্যাঁ, আপনাদের তো বলাই হয়নি, ইনিই আমার মমতাময়ী মা। আমার জান্নাত।

Facebook Comments