আফরোজা হাসান
আমার পড়াশোনার বিষয়টিই এমন যে ভালো কথার চেয়ে মন্দ কথাই বেশি শুনতে হয় আমাকে। সুখের চেয়ে জীবনে বিরাজমান দুঃখের কথাই বেশি জানতে হয়। আনন্দময়তার চেয়ে বেদনাক্ত গল্পগুলোই আগে কড়া নাড়ে আমার দ্বারে এসে।
মানুষের ভেতরের আলোকময়তার চেয়ে অন্ধকারাচ্ছন্নতাই বেশি উন্মোচিত হয় আমার সামনে।
বলা হয়, “কোন জিনিস যখন সচারচর সংঘটিত হয় মানুষ সেটার সাথে অভ্যস্ত হয়ে যায়। একসময় সেই জিনিসটা মানুষের মনের আর তেমন করে প্রভাব ফেলতে পারে না।” কিন্তু এই ক্ষেত্রে কেন জানি না আমার সাথে এমন হয়নি। এখনো কারো কষ্টের কথা শুনলে, দুঃখের কথা জানলে, বেদনাক্ত চেহারা দেখতে, অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে আছে অনুভব করলে খুব বেশি কষ্ট হয়।
এমন মানুষগুলোর পাশে গিয়ে দাঁড়াতে ইচ্ছে করে! তাদের পানে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করে! যে গোলক-ধাঁধায় তারা ঘুরপাক খাচ্ছে সেখান থেকে বের করে নিয়ে আসতে ইচ্ছে করে।
অন্ধকারে নিমজ্জিত মনগুলোকে অভয় দিয়ে বলতে ইচ্ছে করে, এই তো আরেকটু এগোলেই পেয়ে যাবে আলোর সন্ধান। ধৈর্য্য ধরে রেখে কদম সামনে বাড়াও। উঁচু নীচু পথ দেখে ভয় পেয়ো না। দূর থেকে দেখছো তো তাই এমন মনে হচ্ছে। যখন চলতে শুরু করবে নিজের অজান্তেই দেখবে পথের সাথে তাল মিলিয়ে, সব বাঁক পেড়িয়ে ঠিকই এগিয়ে যাচ্ছো গন্তব্য পানে ইনশাআল্লাহ।
‘নানান প্রতিকূলতায় জীবনের পথ যখনই লাগবে খুব দুর্বোধ্য, রাখবে মনে আলো আঁধারের মাঝে আলো সর্বদা অপ্রতিরোধ্য’।
এই কথাটা চলার আমি সবসময় মনে রাখতে চেষ্টা করি। তাই যখনই কোন কারণে চোখের সামনে হঠাৎ আঁধারের পর্দা নেমে আসে। নিজেই নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করি এই আঁধার ক্ষণস্থায়ী রূপে এসেছে। কেননা আলোকে বেশীক্ষণ আড়াল করে রাখার ক্ষমতা আঁধারের নেই।
আমার কাছে যখনই কেউ কোন সমস্যা নিয়ে আসে একথাটাই বোঝাতে চেষ্টা করি। কিন্তু অনেক সময় কেউ কেউ এত বেশি বেদনাহত থাকেন তাদেরকে বোঝাতে গেলে বোঝেন তো নাই, উল্টো ভয়াবহ রকম উত্তেজিত হয়ে যান। কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে মনের সব রাগ ঝেড়ে গটগট করে উঠে চলে যান। ও হ্যা যাবার সময় স্বশব্দে দরজা বন্ধ করতে ভুলেন না।
আমার সাথে এমন যে ক’বারই হয়েছে দরজা বন্ধের শব্দে চমকে উঠেছি ভীষণ ভাবে। মনে হয়েছে ঠিক এতটাই প্রচন্ডতার সাথেই সেই ব্যক্তি তার মনের দরজাটাও বন্ধ করে দিলেন। এর ফলে না তার ভেতর থেকে বদ্ধ বাতাস বেড়িয়ে আসতে পারবে, না বাইরে থেকে বিশুদ্ধ বাতাস ভেতরে প্রবেশ করতে পারবে। যার ফলে গুমোট পরিবেশে দমবন্ধ করা এক অস্বস্থিতে কাটবে তার সময়। যা তাকে আরো নাজুক ও দুবর্ল করে তুলবে সমস্যার মোকাবিলায়।
এমন মানুষগুলোর পাশে গিয়ে দাঁড়াতে ইচ্ছে করলেও, তাদের কষ্টগুলোকে মমতার পরশ বোলাতে চেষ্টা করলেও তারা কাউকে সেই সুযোগ দিতেই নারাজ থাকেন। বিদ্বেষে তাদের মনের পেয়ালা এতটাই টইটুম্বুর থাকে সেখানে মমতা মাখা শব্দরা পড়া মাত্র গড়িয়ে বাইরে বেড়িয়ে যায়। জায়গা করে নিতে পারে না কোমল ভালোবাসা।
ঘৃণার আগুনের তাপে গলে যায়। ঘৃণার এমন দহন ক্ষমতা দেখে বুক কেঁপে ওঠে। কাছে যেতে চাইলে আমাকেই না জ্বলসে দেয় ঐ আগুন সেই আতঙ্ক ঘিরে ধরে মনকে। বাবা বলেছিলেন, ক্ষেতে কৃষক যে বীজ বোনে সেই ফসলই ঘরে তোলে। ঠিক তেমনি মানুষের মনেও তুমি যা বুনবে তাই ফিরে পাবে। আমার নিজ অভিজ্ঞতায় মনের ব্যাপারে বাবার কথাটা অবশ্য সবসময় সত্য বলে প্রমানিত হয়নি।
ভালো কিছু বোনার পরেও অনেক সময় একদম বিপরীত কিছু ফিরে পেতে হয়েছে অনেক মনের কাছ থেকেই। এক সময় ব্যথিত হতাম খুব এটা নিয়ে। মনে হতো আমি এত ভালো ব্যবহার করছি তাহলে মানুষ কেন আমাকে কষ্ট দেয়? কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝতে পেরেছি যে, অনাবাদী জমির মত কিছু কিছু অনাবাদী মনও আছে। সেইসব মনে যত ভালো কিছুই বোনা হোক না কেন অনুর্বরতার কারণে অবিকশিতই থেকে যায়। যার ফলে উত্তম কিছু ফিরে আসার কোন সুযোগই থাকে না।
আবার কত সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি কারণে উর্বর জমিরও তো ব্যর্থ হয় ফসল ফলাতে। তেমন প্রাকৃতিক দুর্যোগের স্বীকার তো মানুষের মনকেও হতে হয় অনেক সময়। তাই দোষ-গুণ যাচাই বাছাই ইত্যাদি ঝামেলাতে এখন আর যেতে চাই না। ভালোটা দিয়েই সন্তুষ্ট থাকার চেষ্টা করি। কারণ উত্তম প্রতিদান দেবার একমাত্র মালিক আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা। প্রতিদান একমাত্র তাঁর কাছেই আশা করা উচিত।
কিন্তু মনখারাপের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারি না। এমন মানুষগুলোর জন্য কিছু করতে না পারার ব্যর্থতা মনকে খুব ব্যথিত করে। এমন মানুষদের প্রতি আমার কখনোই ঘৃণা বা রাগ হয় না। দয়া বা করুনাও হয় না। আমার মায়া হয়। খুব খুব বেশি মায়া।
কারণ নিজের স্বল্প জ্ঞান থেকে এইটুকু অন্তত জানি ও বুঝি যে, ব্যক্তি জীবনের তিক্ততা এই মানুষগুলোকে এমন তিক্ত বানিয়ে দিয়েছে। তাদের মনের তিক্তরার বিষ এমন ভাবে ছড়িয়ে গিয়েছে যে তারা না চাইলেও তাদের ভেতর থেকে বেড়িয়ে আসে বিষবাষ্প।