banner

বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 482 বার পঠিত

 

আমি চাই পৃথিবীটাকে নারীদের জন্য নিরাপদ করে গড়ে তুলতে- সালমা হায়েক

আমি বড় হয়েছি বাবা-মা এবং ছোট ভাইয়ের সঙ্গে, মেক্সিকোর ছোট একটা শহরে। আমাদের বাসা ছিল সমুদ্রের ধারেই। সারা দিন প্রতিবেশী শিশুদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াতাম, রাস্তায়-সাগর পাড়ে ফুটবল খেলতাম। এর চেয়ে ভালো শৈশব একজন শিশু আর কোথায় পাবে?
আমাকে অনেকেই জিজ্ঞাসা করে, আমার নিজের কোনো রোল মডেল আছে কি না, বা অভিনেত্রী হিসেবে আমি কাউকে অনুসরণ করি কি না। জীবনের অনেকটুকু সময় আমি এর উত্তর নিয়ে সন্দিহান ছিলাম। কিন্তু দেরিতে হলেও আমি এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেয়েছি। আমি বুঝতে পেরেছি, আমার পরিবারের সেই সব নারী যাঁরা প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও সেটাকে বিকশিত করার সুযোগ পাননি, তাঁদের স্বপ্নগুলোকে পূর্ণতা দিতে পারেননি—তাঁরাই আমার জীবনের অনুপ্রেরণা।
আমার মাকে তাঁর স্বপ্নের পথ থেকে সরে আসতে হয়েছিল। তিনি একজন সংগীতশিল্পী হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সে সময় সমাজে এটাকে ছোট করে দেখা হতো। তিনি নিজেকে মিথ্যা সান্ত্বনা দিতেন যে তাঁর হয়তো সেই যোগ্যতা নেই। সংগীতের সাধনা করার বদলে তিনি বিয়ে করলেন, তাঁর সন্তানেরা জন্ম নিল। এর অনেক বছর পরে সব প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে তিনি আবার সংগীতের চর্চা শুরু করলেন এবং অসাধারণ সাফল্য পেলেন।
এরপর মা আমাদের শহরে গান শেখার স্কুল খুললেন। শিশুদের অপেরা শেখাতে শুরু করলেন, অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেন। মেক্সিকো সিটি থেকে ভালো শিক্ষক নিয়ে এলেন। তাঁদের অনেক ছাত্র এখন পেশাদার শিল্পী হিসেবে খ্যাতিমান হয়েছেন।
বাবা-মাকে দেখে আমি সব সময়ই মানুষকে সাহায্য করতে শিখেছি। বিশেষ করে বিশ্বজুড়ে নারীদের অধিকার রক্ষায় ‘চাইম ফর চেঞ্জ’ যে লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে, তার সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার অনুপ্রেরণা তাঁদের কাছ থেকেই আমি পেয়েছি। পৃথিবীর যেখানে জনগণ নিপীড়নের শিকার হয়েছে, সেখানে নারীরাই সবচেয়ে নিগৃহীত হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে আমরা দেখতে পাব, সমগ্র আমেরিকাজুড়ে মানব পাচার একটি লাভজনক ব্যবসা। এখানে নারীরা এখনো পারিবারিক নিপীড়নের শিকার হচ্ছে এবং তাঁদের সাহায্য করার জন্য পর্যাপ্ত বিচারিক ব্যবস্থা নেই।
আমার দাদি মারিয়া লিসা লোপেজ, আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। একাধারে তিনি ছিলেন একজন প্রতিভাবান কবি, গীতিকার, বিজ্ঞানী ও রসায়নবিদ। ইতিহাস ও চিকিৎসাবিজ্ঞান নিয়েও তিনি অনেক কিছু জানতেন।
তিনি নিজেই বিউটি ক্রিম বানাতেন এবং বাজারজাত করতেন। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এসব তিনি করতেন তাঁর রান্নাঘরে। তিনি তাঁর সময়ের চেয়ে অনেকটুকুই এগিয়ে ছিলেন এবং যেকোনো কিছুই করতে পারতেন। কিন্তু সময়টা তখন ছিল ১৯৩০। তাই তাঁকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়। পরবর্তীকালে তিনি তাঁর স্বামীকে ত্যাগ করেন এবং মেক্সিকো সিটিতে চলে এসে নিজের ব্যবসা শুরু করেন।
নিজেকে একজন মা ভাবতে আমি গর্ব বোধ করি। কিছু মানুষের জন্য মাতৃত্ব একটা কাজের বোঝা। কিন্তু আমার জন্য তা নয়, এটার কারণ হতে পারে আমি আমার মেয়ে ভ্যালেন্তিনা’কে পেয়েছি জীবনের ৪১তম বছরে এসে।

images
আমার অনেক বন্ধু, যাদের কোনো সন্তান নেই তারা বলে, আমার সঙ্গে থাকা অসম্ভব। কারণ, আমার সব কথাই মাতৃত্বকে কেন্দ্র করে। কিন্তু একজন মা হওয়া হাজারো কাজের চেয়ে ক্লান্তিকর। মা হওয়া ছাড়া আমি এখন কোনো কাজ করছি না। আমি এখন যে কাজটি করছি সেটি টাকার জন্য নয়। এটা মানুষ হিসেবে আমার নিজের উন্নতির জন্য।
আমি যখন অভিনয় শুরু করি, আমাকে বারবার বলা হয়েছিল, আমি যথেষ্ট ভালো না। কিন্তু আমি প্রতিবার নিজেকে বলেছি, আমাকে লেগে থাকতে হবে। আমি এখন বুঝতে পারি, আমার মা ও দাদির অভিজ্ঞতাগুলো আমাকে কতটুকু সাহায্য করেছিল। ভ্যালেন্তিনাকেও আমি একইভাবে বড় করতে চাই। তার ওপরে আমি কোনো স্বপ্ন বা চাহিদা চাপিয়ে দিতে চাই না। আমি চাই, সে বড় স্বপ্ন দেখবে এবং নিজের যোগ্যতায় সেটা অর্জন করে নেবে।
একজন অভিনেত্রী হিসেবে, একজন মা হিসেবে আমি সব সময়ই সেরা কিছু করতে চেয়েছি। কারণ, আমি সেই সব মহান নারীকে নিজের মধ্যে ধারণ করতে চেয়েছি, যাঁরা নিজেদের প্রতিভার প্রাপ্য সম্মানটুকু পাননি।
আমি নিজেকে একজন নারীবাদী হিসেবে ভাবি। কারণ, আমি নারীদের ভালোবাসি এবং তাঁদের জন্য লড়াই করতে প্রস্তুত। আমি চাই পৃথিবীটাকে নারীদের জন্য নিরাপদ করে গড়ে তুলতে। আমি নারীবাদী কারণ, বন্ধু হিসেবে, সহকর্মী হিসেবে আমি প্রতিদিনই নারীদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হচ্ছি। অনেক অসাধারণ নারী আমাকে আজকের আমি হিসেবে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করেছেন।

সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান। ২৯ মার্চ, ২০১৩ সালে দ্য গার্ডিয়ানকে দেওয়া সাক্ষাৎকার অবলম্বনে লিখেছেন মনীষ দাশ

Facebook Comments