মুক্তারা বেগম নদী
আজ ১লা আষাঢ়, বর্ষার প্রথম দিন। কিন্তু আজ আমি কোথাও যাব না, মন ভাল নেই। আজ অসম্ভব ইচ্ছে করছিল অঝোর ধারায় বৃষ্টি হোক কিন্তু আমি জানি আজ বৃষ্টি হবে না, আমি যে বৃষ্টিকে অনেক অনেক ভালবাসি। আমি যা ভালবাসি, যা চাই তা কখনও হবে না, হতে নেই। বৃষ্টির কাছে আমার অসীম কৃতজ্ঞতা, কারন বৃষ্টি আমার কান্নার নোনা জল মুছে দেয়। বৃষ্টি নিয়ে আমার অনেক আদিখ্যেতা আছে, বৃষ্টি হলেই আমার মন এলোমেলো হয় যায়। তুমি তো জানো অরন্য আমি বৃষ্টিতে ভিজতে ভীষণ ভালবাসি। আরও ভালবাসি শাড়ি পড়তে কিন্তু আজ প্রিয় রঙের নীল শাড়ি, চুড়ি, টিপে নিজেকে সাজাবো না, ঘন কালো চুলগুলো বেলী ফুলের মালা দিয়ে জড়াবো না, কোন এক শান্ত নদীর জলে পা ডুবিয়ে বসা হবে না, বৃষ্টি ভেজা কদম ফুল নিয়ে আসবে না আমার জন্য, তবু আমি অপেক্ষা করব।
আজ সারাটা দিন কষ্টের নীল চাদর জড়িয়ে থাকব, আমার কষ্টের রূপ আর অপেক্ষা কোনটাই যক্ষের বিরহের মত নয় যে কালিদাস তার অলংকার দিয়ে সাজাতে পারবেন। কারণ আমার কষ্ট আর অপেক্ষায় আর যাই হোক কোন অলংকার নেই। আমার অপেক্ষা বা কষ্টগুলো অনেক বেশী সাধারণ, কখনো কখনো হয়ত তার রঙ বদলায় লাল, নীল, বেগুনি হয় কিন্তু কষ্টগুলো কষ্টই থেকে যায়। আমি এমনই একজনকে ভালবাসি যে আমার স্বপ্নে আছে কিন্তু জীবনে নেই। ভীষণ অবাক লাগে, খুব বেশী কিছু চাইনি, শুধু চেয়েছিলাম একদিন ঝুম বৃষ্টিতে তোমার হাতে হাত রেখে পথ চলতে, কোন এক বৃষ্টি ভেজা বিকালে তোমার চোখে চোখ রেখে রংধনু দেখতে, কোন এক সোনালী সন্ধ্যায় মুখোমুখি বসে থাকতে মৌন সুখে, বসন্তের প্রথম প্রহরে পাশাপাশি পথ চলতে, জ্যোৎস্না ভেজা রাত্রিতে তোমাকে নিয়ে ভেসে যেতে।
প্রতিটা সন্ধ্যায় আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করি, এই বুঝি তুমি এলে আমার দুয়ারে, হাতে আমার প্রিয় বেলী ফুলের মালা নিয়ে। সমস্ত শহর তন্ন তন্ন করে তুমি আমার জন্য কোন একদিন একটি নীল গোলাপ নিয়ে আসবে ভেবে ভেবে ফুরিয়ে গেল আমার সারাটি বেলা। তাই দেখে খুশিতে মাতাল হব না কোনদিন জেনেও অপেক্ষার ক্ষণগুলো রক্তাক্ত করে দিয়ে যায় আমায়, আমি পড়ে থাকি জমাট লাল রঙের মাঝে। তোমাকে সঙ্গে নিয়ে কোনদিন শিউলি কুড়ানো হবে না জেনেও আমি অপেক্ষা করি, অপেক্ষা করি আর মলিন হই।
ভোরের আলোয় তোমাকে দেখার ভীষণ সাধ ছিল, রাঙ্গা ভোরে তুমি আসনি, দুপুরের কড়া রোদে তোমাকে কেমন দেখায় তা অজানাই থেকে গেল। কারণ দুপুরের পথও আমাকে নিরাশ করেছে। শেষ বিকালের রক্তিমায় তোমার রঙ কি বদলায়? তাও জানি না কারণ বিকালেও আসনি তুমি। খুব বেশী কি চেয়েছিলাম? এই ভেবে ভিজে যায় আমার চোখ, চোখের পাতা, ভিজে যায় আমার সনাতনী মন।
সমুদ্রের খুব কাছে গিয়ে জলকে স্পর্শ করার বড্ড বেশী সাধ হয়, ইচ্ছে করে তোমাকে সাথে নিয়ে ঝিনুক কুড়াই। ভীষণ ইচ্ছে করে লাল, নীল, বেগুনি ছবি আঁকার। কিন্তু সে জানি তা কোনদিন হবে না, হতে নেই। ভীষণ ইচ্ছে তোমাকে পাশে নিয়ে কোন এক সবুজ পাহাড়ের গায়ে হেলান দিতে। বুকের ভিতর ঘাপটি মেরে বসে আছে এক বিশাল নীলাঞ্জনা আকাশ, চোখের তারায় নাচে একশ কোটি নক্ষত্র। ফিরে আসি একই আবর্তে, নৈবদ্য সাজাই ভীষণ গোপনে।
জানো অরন্য, প্রত্যেক মানুষের মনের ভিতরেই একটা ছোট ঘর থাকে, একটা মাত্র দুয়ার তার। ঘরের ভিতরে থাকে আসল মন আর দুয়ার থাকে বদ্ধ। বদ্ধ ঘরে বসে সে মন শুধু কাঁদে শুধু একজনের কথা ভাবে। কিন্তু বেশীর ভাগ মানুষই মনের সে মানুষটাকে পায় না। মনের কথা বলার মানুষটাকে পায় না। দুয়ার বদ্ধ ঘরে বসে শুধু সারাজীবন কাঁদে, শুধু কাঁদে। যখন তোমায় কথা মনে পড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস হৃদয়ে গুমড়ে উঠে-আমি লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদি যখন পৃথিবী ঘুমিয়ে পড়ে। আর বাতাস যখন উঠে তখন বুকের মধ্যে ঢেউ থাকে না,পড়ে থাকে আমার পুস্পিত ভালবাসা, অনাদর, অবহেলায়।
মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে হ্রদয় থেকে ভালবাসার অনুভূতিটাকে ছিঁড়ে নিয়ে নির্লিপ্তে ছুড়ে ফেলি বঙ্গোপসাগরে, মৌসুমী সমুদ্রের পেটের মতো দুঃখগুলো যখন ফুলে ফেঁপে উঠে, তখন ইচ্ছে করে চোখ বুজে চলে যাই ব্যবলিনের শূন্য উদ্যানে। তোমাকে না পাওয়ার কষ্টে নিজেকে পোড়াতে পোড়াতে ভাবি জীবনের এতটা পথ একাই হেঁটেছি, একাই থেকেছি, বাকীটাও না হয়।
অরন্য, আমার কাছে তোমার কোন ঠিকানা নেই, তাই এই না বলা কথাগুলো কখনই পৌছাবে না তোমার কাছে। তুমি কখনই জানবে না কতটা তীব্রতা ছিল তোমাকে পাবার। কেমন করে তোমাকে খুঁজে বেড়াই দিনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। তোমাকে ভুলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেই জ্বলে উঠে আমার দমিয়ে রাখা ভালবাসা।
তারপর কোনে এক বসন্ত বিকালে ঝড়ে যাবে জীবন বৃক্ষের পাতা ক্লান্ত বাতাসে ভাসবে আমার না বলা কথা। বাতাসের কানে তবু বলাবলি হবে।
এতো ভালবাসে কি আর কেউ? এমন করে?
তোমার বন্যা