কবীর মনিরুজ্জামান
বাংলা ভাষায় ‘আপনি’, ‘তুমি’, ও ‘তুই’ এর বিস্তৃত ব্যবহার আছে। এই শব্দগুলো ইংরেজীতে এক (you-ইউ) হলেও বাংলায় আলাদা অর্থ বহন করে।
এই শব্দগুলো আমাদের ভদ্রতা ও সৌজন্যবোধ, সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা এবং পারষ্পরিক শ্রদ্ধাবোধের পরিচয় প্রকাশ করে।
তুমি
‘তুমি’ সম্বোধন টি অনেক ক্ষেত্রেই সম্পর্কের গভীরতা, নৈকট্য ও আন্তরিকতার উপর নির্ভর করে। নতুন পরিচিত মেয়েটাকে তুমি বলার পার্মিশন চাওয়ার মাঝে অনেক রকম অর্থ বুঝানো হয়।
তুই
‘তুই’ সম্বোধন তুচ্ছার্থে কিংবা ঘনিষ্ঠতা অর্থে ব্যবহৃত হয়। সহপাঠী বন্ধুদের তুই বলতে পারার মাঝে ঘনিষ্ঠতা বা তাচ্ছিল্য প্রকাশের একটা স্টেজ অতিক্রম করা বুঝায়। কাউকে তুই-তোকারী করতে পারলে যেন আমাদের অনেক বেশী বড়ত্ব প্রকাশ হয়।
তুমি ও তুই
ক্ষেত্র বিশেষে তুমি বা তুই অনেক আন্তরিক শোনায়। মা-বাবাকে আপনি বা তুমি বলার মাঝে সম্মান ও ঘনিষ্ঠতা প্রকাশে কোন পার্থক্য হয় বলে আমার মনে হয় না। ছোট বাচ্চাকে তুমি বলার মাঝে আদর প্রকাশ পায়। সম্পর্কের ঘনিষ্টতা বা পুর্বানুমতি ছাড়া কাউকে তুমি সম্বোধন অনেক ক্ষেত্রেই বিব্রতকর হয়ে দাড়ায়।
আপনি
সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রফেসর বি চৌধুরী একবার একটা আন্দোলন শুরু করেছিলেন। তা হল ‘অপরিচিতকে আপনি বলুন’। জানি না তার এই আন্দোলনের মুলে কোন ধরনের চেতনা কাজ করেছিল। তবে তার এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে আমার মনে ধরেছিল। কারণ আপনি তুমির যন্ত্রণা কম বেশি আমাদের সবাইকেই সইতে হয়। আমরা অনেক সময়ই বয়সে বা পদমর্যাদায় ছোট হলেই তুমি করে সম্বোধন করার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠি।
প্রতিপক্ষের মর্যাদা মূলত কি?
পরিচয়ের শুরুতেই আমরা প্রতিপক্ষের মর্যাদা নির্ণয়ে তৎপর হয়ে পড়ি। অন্য অর্থে পরিচয়ের শুরু থেকেই আমরা একে অপরকে সম্মান করব কি করব না বা কতখানি সম্মান করব এর মাপ জোক করতে থাকি। এটাই আমাদের কালচার। আমার ধারনা আমাদের এই কালচারের মধ্যেই উত্তর নিহিত রয়েছে যে, কেন আমরা বাঙ্গালী/বাংলাদেশীরা পরস্পরকে শ্রদ্ধা করতে, ভালবাসতে বা বিশ্বাস করতে পারিনা। কারন এই শ্রেণীবিন্যাস করার প্রবণতা থেকেই আমাদের মাঝে সুপিরিয়রিটি বা ইনফেরিয়রিটি কমপ্লেক্স আমাদের মননে বাসা বেধে ফেলে।
পশ্চিমা এবং আরব কালচার
পশ্চিমা এবং আরবরা এই ‘আপনি-তুমি-তুই’র জটিলতা থেকে মুক্ত হতে পেরেছে। কিন্তু আমরা বাঙ্গালিরা পারিনি। তাদের একটাই শব্দ- ইউ (you), আমাদের অনেক। বিদেশে গেলে তো বয়সে অনেক ছোটরাও নাম ধরে ডাকে এবং তা স্বাভাবিক লাগে, তুমি শোনা তো ব্যাপারই না। কারন ওটাই ওখানকার কালচার। ওরা তো বাপকেও নাম ধরে ডাকে। ‘আপনি, তুমি, তুই’র জটিলতা না থাকায় মর্যাদা নির্ণয়েরও কোন প্রশ্ন নেই। ফলে ঐ ভাষার জাতিগুলোতে পরিচয়ের প্রথম থেকেই সবাই সমান।
আপনি, তুমি এবং তুই
ইদানিং আমাদের দেশেও নব্য ইউরোপিয়ানরা নাম ধরে ডেকে ইংলিশ ব্যবহার করে আপনি তুমির ব্যাপারটা এড়িয়ে যেতে চায়। ভারতীয় বাঙ্গালিরা নাকি অনায়াসে অপরিচতকেও তুমি বলে সম্বোধন করে। যেটা আমরা পারিনা। এটি আসলে আমাদের একটি অন্ত:সারশূন্য জাতিগত ইগো। হায়রে আমাদের অন্তঃসারশূন্য অহম! কাজের কাজ আমরা কিছুই পারি না, খালি অর্থহীন অহমিকা! আমাদের এই অনাহুত সামাজিক hierarchy ভেঙ্গে সাম্যতা আনার প্রথম পদক্ষেপ হল ‘আপনি, তুমি, তুই’ থেকে বেরিয়ে আসা।
কিন্তু কিভাবে তা সম্ভব? আদৌ কি তা সম্ভব?
(সংগৃহিত ও সংকলিত)