banner

বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 355 বার পঠিত

 

আপনার শিশু, আপনার ভবিষ্যৎ -1

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কোরআনে বলেছেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা তোমাদের নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা কর।” হযরত আলী(আঃ) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন, “নিজেকে, পরিবারকে ও সন্তান-সন্ততিকে উত্তম জ্ঞান শিক্ষা দাও এবং তাদেরকে প্রশিক্ষণ দাও-যাতে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি পেতে পারো।”
সত্যি-সত্যিই বর্তমান বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং প্রশিক্ষণের জগতে যে বিষয়টি বেশ আলোচিত তা হলো মানব শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ। মানব শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গী হলো-ব্যক্তিত্বের যথাযথ বিকাশের মাধ্যমে ইনসানে কামেল বা পরিপূর্ণ মানুষে পরিণত করা। তাই জন্ম পরবর্তী সময়তো বটেই, এমনকি জন্মপূর্বকালেও ইসলাম বিভিন্নভাবে এই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে। জন্ম-পূর্ববর্তীকালের প্রশিক্ষণটি হলো একটি সুশৃঙ্খল পরিবার গড়ে তোলা। আর জন্ম-পরবর্তীকালে নবজাতকের প্রশিক্ষণের ব্যাপারেও ইসলাম দিয়েছে চমৎকার কালজয়ী দিক-নির্দেশনা। জন্ম পরবর্তী একটি সন্তানের জীবনকালকে পাঁচটি পর্যায়ে ভাগ করা যেতে পারে। যেমন শিশুকাল, কিশোরকাল, যৌবনকাল, মধ্যবয়স বা বয়োপ্রাপ্তকাল এবং বার্ধক্যকাল।

আমরা এখানে প্রথম তিনটি পর্যায় নিয়ে আলোচনা করবো। রাসূলে কারীম(সাঃ) মানব সন্তানের বেড়ে ওঠার প্রাথমিক কালগুলোকে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পর্বে ভাগ করে বলেছেন, “সন্তান তার প্রথম সাত বছরে হলো সাইয়্যেদ বা মহোদয়, দ্বিতীয় সাত বছরে হলো আনুগত্যকারী বা আদেশ মান্যকারী আর তৃতীয় সাত বছরে হলো মন্ত্রী বা দায়িত্বশীল। কী সুন্দর উপমা দিয়ে, পরিভাষা দিয়ে রাসূল শিশুর বেড়ে ওঠার কাল এবং আচরণগত বৈশিষ্ট্যগুলোকে তুলে ধরেছেন। আমরা তাঁর এই পরিভাষাগুলোকে খানিকটা ব্যাখ্যা করে বলার চেষ্টা করবো।
একুশ বছর বয়স পর্যন্ত একটি সন্তানের বেড়ে ওঠার পর্বগুলোকে রাসূল (সাঃ) যেভাবে নির্দেশ করেছেন, তাকে শিশুকাল, কিশোরকাল এবং যৌবনকালের বৃত্তে ফেলা যেতে পারে। শিশুকালটিকে যদি আমরা কর্তৃত্বের অর্থে ধরে নিই, যেমনটি রাসূল বলেছেন, তাহলে তার অর্থ দাঁড়াবে, শিশু এ সময় যা খুশি তা-ই করবে। এ সাত বছর শিশু সম্পূর্ণ স্বাধীন। তার সকল কর্তৃত্ব মেনে নিতে হবে। এভাবেই শিশু সাত বছর কাটিয়ে দ্বিতীয় সাতে গিয়ে পড়বে। দ্বিতীয় সাত মানে হলো আনুগত্য বা আদেশ পালন করার পর্ব। অর্থাৎ এই পর্বে শিশুকে আর স্বাধীনভাবে কর্তৃত্ব করতে দেয়া যাবে না। বরং তাকেই বাবা-মা বা অন্যান্য মুরুব্বীদের কথা মেনে চলতে হবে। এই দ্বিতীয় সাত অর্থাৎ সাত বছর থেকে চৌদ্দ বছর পর্যন্ত সময়কাল যদি একটি শিশু যথাযথ নির্দেশনা মেনে বেড়ে ওঠে, তাহলে তৃতীয় সাত বছর অর্থাৎ চৌদ্দ থেকে একুশ বছর বয়সকাল পর্যন্ত শিশুটি হয়ে উঠতে পারে সংসার পরিচালনায় বাবা-মায়ের একজন যথার্থ সহযোগী। রাসূল(সাঃ)এর আরেকটি হাদীসে এ পর্ব তিনটিতে সন্তানদের প্রশিক্ষণ এবং বাবা-মায়ের করণীয় আরো পরিস্কারভাবে ফুটে উঠেছে। তিনি বলেছেন, তোমাদের সন্তানদেরকে সাত বছর পর্যন্ত খেলাধূলা করতে দাও, পরবর্তী সাত বছর তাদেরকে সংশোধনীমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দাও এবং পরবর্তী সাত বছর তাদেরকে তোমাদের পরামর্শদাতা ও সহযাত্রী কর। জীবনের প্রথম সাতটি বছরে একটি শিশুর অনুধাবনশক্তি কিংবা স্মৃতিশক্তি থাকে একেবারেই অপক্ক। তার শারীরিক অবস্থাও থাকে অত্যন্ত নাজুক পর্যায়ে। তাই এ সময়টায় বাবা-মায়ের উচিত সন্তানের প্রতি সদয় ও সহানুভূতিশীল আচরণ করা। তার চাহিদাগুলোকে সাধ্যমতো পূরণ করা এবং তাঁর জিজ্ঞাসাগুলোর ইতিবাচক জবাব দেয়া। শিশু তার প্রথম সাত বছর পর্যন্ত স্বাধীন। তাই স্বাধীনভাবে সে খেলাধূলা করবে, নাচানাচি-দৌড়াদৌড়ি করবে, আদেশের পর আদেশ দেবে-যা খুশি তাই করবে। এসবের মাধ্যমে তার মধ্যে ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠবে। তাই তার ওপর এ সময় কোন নিষেধাজ্ঞা বা সীমাবদ্ধতা আরোপ করা অনুচিত। এমনকি তাকে এসময় কোন কিছু সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়াও ঠিক নয়। শিশু তার বাবা-মা তথা পরিবারের সকল মুরব্বী, পাড়া-প্রতিবেশী, আশে-পাশের লোকজন এবং অন্যান্য শিশুদের প্রভাবেই বড়ো হয়ে উঠবে।
নিঃসন্দেহে, জীবনের প্রাথমিক পর্বের বছরগুলোই যে-কোন মানুষের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রভাব সৃষ্টিকারী। কারণ এ সময়টাই মানুষের ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠার সময়। অতীতে মনে করা হতো যে, শৈশবে একটি শিশুর শারীরিক সুস্থতার প্রতিই কেবল মনযোগী হওয়া দরকার। এর বাইরে শিশুর আবেগ-অনুভূতি, সামাজিকতা, এবং তার মেধাকে প্রতিপালনের ক্ষেত্রে কোন গুরুত্বই দেয়া হতো না। তাদের চিন্তা ছিল এমন যে, শিশু যদি অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে টানাপোড়েনে না ভোগে, তাহলে তার শারীরিক, মানসিক এবং মেধার বিকাশ অন্যদের তুলনায় দ্রুত লাভ হবে। কিন্তু আধুনিককালে বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে দেখা গেছে, শিশুর বেড়ে ওঠার সকল পর্যায়েই শুধুমাত্র শারীরিক বিকাশ নয় বরং তার আবেগ-অনুভূতি, বোধ-উপলদ্ধি, তার কল্পনা-স্মরণশক্তি এবং সেই সাথে শিশুর কথা বলার দক্ষতার ব্যাপারেও সচেতন দৃষ্টি রাখা অনিবার্য।
শিশুদের বেড়ে ওঠার সময় তাদের শারীরিক এবং আচার-আচরণে যেসব অসংলগ্নতা দেখা দেয়, বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই তা ঘটে থাকে শিশুর বেড়ে ওঠার পর্যায়গুলো সম্পর্কে যথার্থ ধারণার অভাবে এবং পর্যায়ক্রমিক সঠিক ব্যবস্থা ও পদপে গ্রহণ না করার কারণেই। যৌবনে পৌঁছে মানুষ সন্ত্রাসী-মাস্তানী, রাহাজানীসহ যেসব অসামাজিক ও অনৈতিক কার্যকলাপ করে থাকে, গবেষণায় দেখা গেছে জীবনের প্রাথমিক পর্যায়গুলোতে যথার্থ নার্সিং এর অভাবই এ ধরণের ক্রিয়াকলাপের মূল কারণ।
তাই শিশুর প্রতিপালনে বাবা-মায়ের সচেতনতা খুবই জরুরী। রাসূল(সাঃ) যে সূক্ষ্ম দিক-নির্দেশনা দিয়ে গেছেন, আমরা তা ধীরে ধীরে বিশ্লেষণ করে দেখার চেষ্টা করবো-শিশুর বেড়ে ওঠার পর্যায়গুলোতে তার যথার্থ যত্ম নিতে হবে কীভাবে। বলাবাহুল্য: রাসূলের নির্দেশনা যে অকাট্য, তাঁর পরিচর্যারীতি যে বিজ্ঞানোত্তীর্ণ, তা জ্ঞান ও প্রযুক্তিতে উন্নত আধুনিক এ বিশ্বের গবেষকরাও প্রমাণ করতে সম হয়েছেন। তাই আমরা রাসূলের নির্দেশনাকে সর্বাধিক প্রাধান্য দেবো। ২য় পর্বভোরের নরম আলোর মতো শিশুর গালে সুপ্রভাতের প্রথম আদরটি দিয়ে, বিকশমান ফুলের মতো অনাবিল হাসিটি দেখতে কার না ভালো লাগে বলুন: কিন্তু শিশুর এই নির্মল হাসিটিকে তার প্রাপ্ত বয়স পর্যন্ত ছড়িয়ে দিতে পিতামাতার অনেক করণীয় রয়েছে। বিশেষ করে জীবনের প্রথম সাত বছরের পর্বটি হলো তার মানস বিকাশের সময়। নবীন কিশলয় অর্থাৎ গাছের সুগন্ধিময় নতুন পাতার মতো বয়স তার, নবীন পাতাটির মতোই সে নাজুক এবং স্বচ্ছ। অন্যভাবে বলা যায়, জীবনের প্রথম পর্বটি কাঁচা মাটির মতো। এ মাটি দিয়ে বাবা-মায়ের মতো জীবনশিল্পীরা যা গড়তে চান, তা-ই পারবেন। এ কথা থেকে সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, বাবা-মা কে শিল্পী হতে হবে, জীবন গড়ার শিল্পী। আর শিল্পী হতে হলে জানতে হবে শিল্পের কলা-কৌশল। এর আগের আলোচনায় এইসব কৌশলগত জ্ঞান নিয়ে খনিকটা আলোচনা করা হয়েছে। এবারও তা অব্যাহত রাখবো।
রাসূল(সাঃ) একটি সন্তানের জীবনকে তিনটি ‘সপ্তবর্ষে‘ ভাগ করেছেন। প্রথম সাত বছরকে শিশুর স্বাধীনতার কাল বলে ঘোষণা করেছেন। এই স্বাধীনতার সময়ে শিশুর সাথে কী ধরণের আচরণ করা উচিত-সে সম্পর্কেই আমরা আলোচনা করছিলাম। প্রথম সাথ বছর একটি শিশুর মেধা যেহেতু পর্যাপ্ত পরিমাণ বিকাশ লাভ করে না, সেহেতু এ বয়সের একটি শিশুর মেধা নিয়ে বিশ্লেষণ না করে বরং তার পঞ্চ-ইন্দ্রিয়ের অনুভূতি এবং প্রতিক্রিয়ার প্রতিই মনযোগী হওয়া উচিত। অনুভূতিগত দিক থেকে দেখলে দেখা যাবে যে, শিশুরা পঞ্চ-ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য কাজে এ সময় ব্যাপক তৎপর হয়ে ওঠে। সে দৌড়াতে পছন্দ করে, খেলাধুলা পছন্দ করে ,কোন বিষয়ে কৌতূহলী হয়ে পড়লে প্রশ্ন করতে পছন্দ করে, সর্বোপরি নতুন নতুন বিষয়কে তার অভিজ্ঞতার ভান্ডারে জমাতে পছন্দ করে। আর এ কারণেই সে তার চারপাশে যা কিছুই দেখে, তা-ই ধরতে চায় এবং একাকী নিজস্ব অনুভূতি দিয়ে তাকে বুঝতে চায়, শিখতে চায়, অভিজ্ঞতা অর্জন করতে চায়। শিশুর স্বাধীনতা মানে তার অনুভূতির স্বাধীনতা, তার মাংসপেশীর স্বাধীনতা। এ দুয়ের যথেচ্ছা ব্যবহারের ফলে শিশুর চলাফেরা তার সৃজনশীলতা এবং তার ইন্দ্রিয়ের বিকাশের ভিত্তিভূমি রচিত হয়। তাই শিশুর প্রথম সাত বছরে তার সাথে এমন কোন কাজ করা উচিত নয়, যাতে তার স্বাধীনতা বিঘ্নিত হয় এবং পরিণামে তার ইন্দ্রিয় ও সৃষ্টিশীলতা বিকাশের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। মনে রাখতে হবে, শিশুর মানসিক তথা সৃজনশীলতার বিকাশ যদি বাধাগ্রস্ত হয়, তাহলে শিশুর মনোবিকার ঘটতে পারে। আর তা যদি একবার ঘটেই যায়, তাহলে তার ভবিষ্যত হবে বাবা-মায়ের একেবারেই অপ্রত্যাশিত। তাই বাবা-মাকে সচেতন হতে হবে। শিশু যখন তার সঙ্গী-সাথী এবং খেলার সাথিদের সাথে আমোদ-প্রমোদ বা খেলাধূলায় ব্যস্ত থাকে, তখন তাকে কোন ব্যাপারে আদেশ দেয়া উচিত নয়। এমনও বলা উচিত নয়-এটা করো না, ওটা করো না.. ইত্যাদি। তাকে তার আনন্দের ভূবন থেকে হুট করে ফিরিয়ে নেয়াটাও ঠিক নয়। তবে হ্যাঁ, যেসব পিতামাতা আপন সন্তানের প্রশিক্ষণের জন্যে সময় দেয়, তারাই সন্তান প্রতিপালনে সফল।
একই ভাবে যেসব দেশ শিশুদের খেলাধূলা, আমোদ-প্রমোদ বা বিনোদনের জন্যে প্রয়োজনীয় ও যথোপযুক্ত জিনিসপত্র সরবরাহ করতে সম, সেসব দেশই মূলত উন্নয়নশীল বা উন্নত দেশ হিসেবে পরিগণিত।
শিশু যদি তার বেড়ে ওঠার জন্যে একটা মুক্ত পরিবেশ পায় এবং যথার্থ শক্তি বা এ্যানার্জি লাভের জন্যে উপযুক্ত পরিবেশ ও গাইড লাইন পায়, তাহলে তার মানসিক, শারীরিক এবং আচার-আচরণগত বিকাশ বিজ্ঞানসম্মতভাবেই অর্জিত হবে। বাবা-মায়ের এই বিষয়গুলোর প্রতি মনোযোগী হওয়া বাঞ্চনীয়। আগেই বলেছি যে, শিশুদেরকে মুক্ত পরিবেশে স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেয়া উচিত। তাদের এই স্বাধীনতায় সামান্যতম প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হলেও শিশুদের আত্মিক, মনস্তাত্ত্বিক ও আচার-আচরণগত ভারসাম্য লঙ্ঘিত হয়। স্কুলে অধিকাংশ শিশুর মনস্তাত্ত্বিক সমস্যাই তাদের পারিবারিক পরিবেশের পরিণতি। অর্থাৎ সন্তান প্রতিপালনে বাবা-মায়ের যথাযথ ব্যবস্থা বা গাইডেন্সের অভাবেই ঐসব সমস্যার সৃষ্টি হয়ে থাকে। নবজাতকের সাথে বাবা-মায়ের সংবেদনশীল আচরণ করা উচিত। অর্থাৎ সন্তানের আরাম-আয়েশ এবং স্বাধীনতার বিষয়টি অনুভব করা উচিত। অত্যন্ত যতেœর সাথে শিশুকে ঘুম পাড়ানো উচিত। ঘুম থেকে জাগার সময় শিশুর প্রতি রুষ্ট হওয়া ঠিক নয়। শিশুকে আদরের সাথে দুধ খাওয়ানো, তার নষ্ট করে দেয়া জামা-কাপড় পরিস্কারের কাজ আন্তরিকতার সাথে আঞ্জাম দেয়া উচিত। এমনকি শিশু যদি কান্নাকাটিও করে, তবুও তার ওপর রেগে যাওয়া ঠিক হবে না বরং কান্নার একটা ইতিবাচক জবাব দিতে হবে। শিশুর বেড়ে ওঠার প্রাথমিক পর্যায়ে বাবা-মা যদি শিশুর সাথে যথাযথ ব্যবহার করে, তাহলে ভবিষ্যতে শিশুর চারিত্রিক বিকাশ, মানস গঠন এবং তার ব্যক্তিত্বের ওপর বাবা-মায়ের ব্যবহার ও প্রতিক্রিয়ার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। আর যথার্থ ব্যবহার করা না হলে তার নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া পড়বে শিশুর ভবিষ্যত জীবনের ওপর।
শিশুর জীবন বিকাশের প্রাথমিক পর্বে তার শরীর-মন-আত্মা সব কিছুই অত্যন্ত কোমল ও নরম প্রকৃতির থাকে। তার কোমল মন তাই আদর-যত্ম , স্নেহ-ভালোবাসাই প্রত্যাশা করে। সে খেলতে চায়, দৌড়াদৌড়ি করতে চায়। প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়াতে চায়। এ সময় তার হাসিতে যেন বংধনু ছড়ায়, পাথরের দিকে তাকালে পাথরও যেন গলে যায়। গাছের দিকে তাকালে যেন ফুল ফোটে, প্রকৃতি যেন তাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়ে ভরিয়ে দেয় তার মন। তাই বাবা-মায়ের মতো তার আশেপাশের সবারই উচিত এমন স্নেহ ও ভালোবাসাপূর্ণ এবং আদরপূর্ণ ব্যবহার করা, যাতে শিশুর মুখে সর্বদা লেগে থাকে অনাবিল হাসি, আর মন পরিপূর্ণ থাকে আদর-আপ্যায়নে। কোনভাবেই তার সাথে এমন আচরণ করা ঠিক নয় যাতে সে মনে কষ্ট পায়। হাদীস অনুযায়ী প্রথম সাত বছর হলো শিশুর স্বাধীনতার পর্যায়, আনুগত্যের পর্যায় নয়। তারপরও কোন কোন বাবা-মা মনে করেন যে, এ সময় শিশুর উচিত বাবা- মায়ের সকল আদেশ-নিষেধ মেনে চলা অর্থাৎ বাবা-মায়ের পূর্ণ আনুগত্য করা। তারা ভাবেন যে, সন্তানের কাজ হলো কথা শোনা, অন্য কোন কাজ করা উচিত নয়। নিজের জায়গা থেকে তাদের নড়া ঠিক নয়, লাফালাফি করা উচিত নয়, বেশী কৌতুহলী দেখানো ঠিক নয়। সন্তান কেবল চুপচাপ বসে থাকবে, প্রতিবেশীকে বিরক্ত করবে না-এই হলো সন্তানের করণীয়। কিন্তু ইসলাম এবং আধুনিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে শিশুর স্বাধীনতার পর্যায়ে বাবা-মায়ের এ ধরনের খবরদারী একদম অনুচিত।  ৩য় পর্বশিশুর বেড়ে ওঠার প্রথম পর্ব অর্থাৎ প্রথম সাত বছরে, শিশুর যথাযথ বিকাশের জন্যে বৈজ্ঞানিক ও রাসূল(সাঃ) নির্দেশিত প্রতিপালন পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করেছি। শিশুর জীবনের প্রথম সাত বছর হলো, স্বাধীনতার চর্চার কাল। এ সময়টা শিশুর সুপ্ত প্রতিভার উন্মেষ ও বিকাশ লাভ করে। এ সময়টাতে তাই বাবা-মায়ের সচেতনতা খুবই জরুরী। এ পর্বে আমরা শিশুর প্রতিভার উন্মেষকালে পিতা-মাতার করণীয় সম্পর্কে আলোচনা করব।
যে শিশু তার চারপাশের পরিবেশকে মুক্ত-স্বাধীন ও শান্তিময় মনে করে এবং যা চায় তা-ই পায়, সেই শিশুর ব্রেইন বা মেধার উন্মেষ স্বাভাবিক গতিতেই ঘটবে, সেই সাথে সে তার সাধ্যমতো স্বাভাবিক এই মেধার আত্ম-প্রকাশ ঘটাতে চাইবে। কারণ হলো সে তার ব্যক্তিত্ব ও মেধার বিকাশের পথে কোন রকম প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়নি। ভবিষ্যতেও তার জ্ঞান-বুদ্ধি, মেধা ও সৃষ্টিশীলতায় এই অবাধ পরিবেশের প্রভাব পড়বে। পান্তরে, শিশু যদি তার পরিপার্শ্বকে মুক্ত ও স্বাধীন না পায়, তার শিশুসুলভ চাহিদাগুলো যদি না মেটে, অর্থাৎ তার চাহিদা পূরণের পথে যদি কোন রকম প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়, তাহলে তার মেধা বিকাশের পথ বন্ধ হয়ে যাবে। শুধু তাই নয়, এ অবস্থায় শিশুর সুপ্ত প্রতিভাগুলো ধ্বংস হয়ে যাবে এবং তার প্রতিভার উন্মেষ বা বিকাশের আর কোন অবকাশই থাকবে না। এ ধরণের শিশুর ভবিষ্যত অন্ধকার হয়ে পড়ে এবং তারমধ্যে আর কোন সৃষ্টিশীলতাই অবশিষ্ট থাকে না।
একটি শিশু তার প্রথম সাত বছর বয়সে ভাবে, বাবা-মায়ের কাছে সে যা চাইবে, তাই পাবে। অর্থাৎ বাবা-মা তার চাহিদাগুলোকে প্রশ্নহীনভাবে বাস্তবায়ন করবে। সেজন্যে এ সময়টায় বাবা-মায়ের প্রতি শিশুর বিশ্বাস থাকে অগাধ। বাবা-মাকে সে তার বন্ধু, সহযোগী এবং তার একান্ত আশ্রয় মনে করে। তাদেরকে সে নিরাপদ মনে করে এবং সেজন্যেই তাদেরকে সে ভীষণ ভালোবাসে। শিশু যখন বড় হয় তখনও সে বাবা-মায়ের ভালোবাসার কথা ভোলে না। বাবা-মা তাকে যে কী পরিমাণ ভালোবাসতো, আদর-যত্ন করত, সে তা উপলদ্ধি করে এবং তাদের ভালোবাসার কাছে যে ঋণী সে তা অনুভব করে। বড়ো হয়ে তাই এই সন্তান বাবা-মায়ের কথা বেশ মনযোগের সাথে শোনে। তাদের দিক-নির্দেশনা, তাদের জীবন অভিজ্ঞতা থেকে সে লাভবান হয়। যে কোন জটিল ও বিরুপ পরিস্থিতিতে বাবা-মাকেই সে আপন ভাবে এবং তাদের সাথে সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা ও পরামর্শ করে। তাদেরকেই নিজের একান্ত পৃষ্ঠপোষক বলে মনে করে।
সন্তান যেহেতু বাবা-মায়ের প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপন করে, সেহেতু বাবা-মায়ের সকল যুক্তি ও পরামর্শ আন্তরিকতার সাথে গ্রহণ করে। তাদের যথাযথ আনুগত্য করে এবং সর্বাবস্থায় তাদের নির্দেশ মেনে চলে। শিশু জীবনের প্রথম পর্বে বাবা-মায়ের আচরণগত ত্রুটিই যুব সমাজের অধিকাংশ সমস্যার জন্য দায়ী। বাবা-মা, সন্তানের আত্মিক ও মনস্তাত্ত্বিক চাহিদাগুলোর প্রতি কোন রকম মনযোগ না দেয়ার কারণে সন্তান ও বাবা-মায়ের প্রতি আস্থাহীনতায় ভোগে। আর বাবা-মায়ের প্রতি সন্তান যদি আস্থা-বিশ্বাস, নির্ভরতা স্থাপন করতে না পারে, তাহলেই বাবা-মায়ের সাথে তার দূরত্ব সৃষ্টি হয়। এই দুরত্ব সন্তানকে বিপথগামী করে তোলে। এ আলোচনায় নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন যে, সন্তানের বেড়ে ওঠার প্রাথমিক পর্বে বাবা-মাকে কতোটা সচেতন থাকতে হবে। সন্তানের বিপথগামীতা এবং বাবা-মায়ের সাথে তাদের দূরত্ব সৃষ্টির জন্য কিন্তু তারা নিজেরাই দায়ী। ফলে সন্তানকে ভালবাসতে হবে। তার আত্মিক এবং মনস্তাত্ত্বিক চাহিদাগুলো পূরণের ব্যাপারে আন্তরিক হতে হবে। তার বেড়ে ওঠার যথার্থ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। সর্বোপরি, শিশুর ভবিষ্যত যে পিতা-মাতার ওপরই নির্ভর করে-তা মনে প্রাণে উপলদ্ধি করতে হবে।
আসরের এ পর্যায়ে, শিশুর বিকাশের প্রাথমিক পর্ব অর্থাৎ সাত বছরে বাবা-মায়ের কর্তব্যগুলো সম্পর্কে সংপ্তি আলোচনা করবো। আসলে শিশুদের সমস্যাগুলো বাবা-মায়েরই সৃষ্টি। তাই শিশুর সমস্যা এড়াতে বাবা-মায়ের উচিত-
১) সন্তানের জন্যে একটা সময় নির্দিষ্ট করা। তার সমস্যা, তার জিজ্ঞাসা, তার কৌতূহলের যথাযথ উত্তর দেয়া।
২) তার বেড়ে ওঠার জন্যে যথাযথ পরিবেশ নিশ্চিত করা এবং সন্তানের চাহিদাগুলো পূরণে সচেষ্ট হওয়া।
৩) শিশুর ওপর খবরদারী করা থেকে বিরত থাকা উচিত। এটা করো না, ওটা ধরো না, এটা করো, সেটা ধরো-এসব করা ঠিক নয়। তারচে বরং এসব কথা যাতে বলতে না হয়, সে ব্যাপারে আগেই সচেতন থাকা উচিত। এসব করা হলে শিশুর সুপ্ত প্রতিভা বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে।
৪) শিশুর জন্যে যেসব জিনিসপত্র তিকর ও ভয়াবহ, সেসব জিনিস তার হাতের নাগালে রাখা অনুচিত। অন্যথায় শিশু যদি ঐসব জিনিস দিয়ে কোন জরুরী কিছু নষ্ট করে, তাহলে ঐসব জিনিস নষ্ট করার জন্যে শিশুকে কোনভাবেই দোষারোপ করা যাবে না। অর্থাৎ তার ওপর রাগ দেখানো যাবে না।
৫) বাবা-মায়ের উচিত বাসায় তাদের জরুরী জিনিসগুলো যথাযথ জায়গায় রাখা। ছুরি-চাকু বা এ ধরণের ধারালো জিনিসগুলো, বিষাক্ত ঔষধপত্র, কীট নাশক জাতীয় জিনিস, কাঁচের জিনিসপত্র, দামী তৈজসপত্র, জরুরী কাগজপত্র প্রভৃতি শিশুর হাতের নাগালের বাইরে রাখা উচিত।
৬) শিশু যখন জেগে থাকে, তখন এমন কোন জিনিস বের করা বা মেরামত করার জন্যে খোলা ঠিক নয়, যার ছোট্ট একটি যন্ত্রাংশ হারালে বা নষ্ট হলে পুরো জিনিসটাই নষ্ট হয়ে যাবে। অন্যকথায় শিশু এসব যন্ত্রপাতি নষ্ট করলে তার ওপর রেগে যাওয়া ঠিক নয়। কারণ শিশু এ সময়টায় কৌতূহলী হবে-এটাই স্বাভাবিক। তার কৌতূহল থেকে তাকে নিবৃত্ত করা যাবে না। অর্থাৎ এ দিকে এসো না, এটা ধরো না-এরকম বলা যাবে না। পরিবারে যদি স্কুলগামী কোন সন্তান থাকে, তাহলে তার বই-পুস্তকসহ অন্যান্য শিক্ষা-উপকরণ এমনভাবে রাখতে হবে, যাতে শিশু সেগুলো ধরতে না পারে, নষ্ট করতে না পারে। মায়ের যদি সেলাই কাজের অভ্যাস থাকে, তাহলে তা করতে হবে শিশু যখন ঘুমোয় তখন, অথবা এমন কোন জায়গায় যেখানে শিশুর উপস্থিতির সম্ভাবনা নেই। আর সুঁই-সূতা-ব্লেড ইত্যাদি রাখতে হবে নিরাপদ দূরত্বে।
ধরা যাক, বহু সতর্কতার পরও শিশু ব্লেড বা ছুরি-চাকু জাতীয় কিছু একটা হাতে নিল। এ অবস্থায় কী করতে হবে? না, কোন অবস্থাতেই চীৎকার চেঁচামেচি করা যাবে না, বরং তার সামনে এমন অন্য একটা জিনিস এনে হাজির করতে হবে, যাতে শিশুর মনযোগ সেদিকে যায় এবং সুযোগমতো ঐ ভয়ানক বস্তুটি তার হাত থেকে সরিয়ে নেয়া যায়। এমন ভাবে নিতে হবে যাতে শিশুটি একদম টের না পায়।
বাবা-মায়ের এতো সতর্কতার কারণ হলো, এ সময়টা শিশুর পরিপূর্ণ স্বাধীনতার পর্ব। তার যা খুশী তা-ই করবে সে। তাকে আদেশ দেয়া যাবেনা, বারণও করা যাবে না। শিশুর মেধা বিকাশের স্বার্থে বাবা-মা ভালোবেসে, আদর করে এটুকু ছাড় দেবেন-এটাই প্রত্যাশা। ৪র্থ পর্ব‘আজ যে শিশু পৃথিবীর আলোয় এসেছে, আমরা তার তরে একটি সাজানো বাগান চাই।‘ কিংবা ‘এ পৃথিবীকে শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি‘-গীতিকার বা কবির এই যে আকুলতা, এই যে প্রতিশ্রুতি, তা শিশুর প্রতি আন্তরিক ভালোবাসা এবং তার সুন্দর ভবিষ্যত নিশ্চিত করারই প্রয়াসমাত্র। সমস্যা হলো, শিশুর ভবিষ্যত গড়ার স্বপ্ল সবারই আছে। কিন্তু কিভাবে তা গড়তে হবে, সেটা যথার্থভাবে অনেকেরই জানা নেই। তাই এবারের পর্বে আমরা শিশু জীবনের দ্বিতীয় পর্ব অর্থাৎ সাত থেকে চৌদ্দ বছর বয়সকালীন তার আচার-আচরণগত বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করবো।
শিশু জীবনের দ্বিতীয় পর্বটি হলো সাত থেকে চৌদ্দ বছর বয়স পর্যন্ত। এই বিভাজন রাসূল(সাঃ) নিজেই করে গেছেন। প্রথম সাত বছর হলো শিশুর স্বাধীনতার কাল। আর দ্বিতীয় পর্ব হলো শিশুর আনুগত্যের কাল। এই দ্বিতীয় সাত বছরে শিশুর শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন লংঘনীয় পর্যায়ে যায়। তার শরীর আগের তুলনায় একটু শক্ত-সামর্থ হয়, স্মৃতিশক্তি বিকশিত হয়, তার জ্ঞান-বুদ্ধি-উপলব্ধিও বৃদ্ধি পায়। একটা নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত শিশু ভালো-মন্দও বুঝতে পারে। এ কারণে শিশু তার মুরব্বীদেরকে তার কৌতূহল মেটানোর জন্যে বিভিন্ন প্রশ্ন করে বেড়ায়। তবে তার বুদ্ধির যেহেতু পূর্ণ বিকাশ ঘটেনি, সেহেতু কীসে তার কল্যাণ, আর কীসে অকল্যাণ-তা যথার্থভাবে বুঝে উঠতে পারে না। আর বুঝতে পারে না বলেই বাবা-মা বা মুরব্বীদের উচিত হলো, এ সময় তাকে বোঝানো, শেখানো। অর্থাৎ তার কোন্টা করা উচিত, আর কোন্টা করা উচিত নয়-সে ব্যাপারে তাকে দিক-নির্দেশনা দেয়া এ মুহূর্তে অভিভাবকদের কর্তব্য। শিশু এ সময় বাবা-মায়ের কথাবর্তা শনুবে, আনুগত্য করবে-এটাই স্বাভাবিক। বাবা-মা এসময় শিশুকে ভদ্রতা-শিষ্টাচার এসব শেখাবে। শিশুকে জ্ঞান দান ও প্রশিক্ষণ দানের উপযুক্ত বয়সই হলো এই দ্বিতীয় সাত বছর। এ পর্বের শুরু থেকেই শিশুর আনুষ্ঠানিক শিক্ষাজীবনের সূচনা ঘটবে। শিশু স্কুলে যেতে শুরু করবে। তার ওপর পাঠ-অনুশীলনসহ সীমিত পর্যায়ের কিছু কিছু দায়িত্ব ছেড়ে দেয়া হবে। শিশু যদি তার জীবনের প্রথম পর্বটি যথার্থ পরিবেশের মধ্যে কাটাতে সম হয়ে থাকে অর্থাৎ যথার্থ স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে যদি বেড়ে উঠে থাকে, তাহলে আনুগত্যের পর্বে তার একধরণের মানসিক ভারসাম্য সৃষ্টি হবে। তাই অত্যন্ত আন্তরিকতা ও আনন্দের সাথে সে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব গ্রহণ করবে এবং আরো বেশী জীবনাভিজ্ঞতা অর্জনের জন্যে শিশু তার বাবা-মা বা মুরব্বীদের আনুগত্য করবে। তারা যা বলেন, তা শুনবে। যা আদেশ করেন তা পালন করবে। একটা শিশু যখন তার দ্বিতীয় সপ্তবর্ষে পা দেয়, তখন সে উপলব্ধি করতে পারে যে, অভিভাবকদের তুলনায় জ্ঞান এবং যোগ্যতায় সে অনেক পিছিয়ে আছে। অর্থাৎ বাবা-মা যা জানে, সে তা জানে না। তখনই তার মনে নানা রকম প্রশ্ন জাগে। কিন্তু শিশু যেহেতু তার ক্ষুদ্র জ্ঞানের মাধ্যমে সেসব প্রশ্নের সমাধান করতে পারে না, তাই তার প্রয়োজন পড়ে এমন কাউকে-যে তার প্রশ্নগুলোর জবাব দেবে। শিশু চায়, যে তার কৌতূহলগুলোর জবাব দেবে, সে যেন তার প্রতি পরিপূর্ণ মনযোগী হয়, সে যেন কোন রকম দ্বিধা-সংকোচ ছাড়াই তাকে প্রশ্ন করতে পারে এবং জবাব পেতে পারে। সাত থেকে চৌদ্দ বছর বয়সে একটা শিশুর মেধা, জ্ঞান-বুদ্ধি কিছুটা বৃদ্ধি পায়। ফলে তার চাহিদা, তার প্রত্যাশাও আগের তুলনায় কিছুটা উৎকর্ষ লাভ করে। আগের মতো একেবারে শিশুসুলভ আর থাকে না। তাই এ সময়টায় শিশুকে শিক্ষা দেয়া যায়, প্রশিক্ষণ দেয়া যায়। তাকে আর পুরোপুরি স্বাধীনতা দেয়া যাবে না। বরং তার সকল কর্মসূচী ছকে বেধে দিতে হবে, যেন সে শৃঙ্খলা শিখতে পারে। এ সময় তাকে একটু একটু ইবাদত সম্পর্কে শেখানো যেতে পারে।
শিশু জীবনের দ্বিতীয় সপ্তবর্ষে তার মেধা ও স্মৃতিশক্তির বিকাশ ঘটে। তাই এ সময়টাই হলো শিশুকে শেখানোর সময়। বিশেষ করে এই বয়সটাতেই শিশুকে আদব-কায়দা বা শিষ্টাচার এবং ইসলামী আচার-আচরণ পদ্ধতি শেখাতে হবে। স্কুলে শিকদের কাছ থেকে এবং বাসায় বাবা-মায়ের কাছ থেকে এই দ্বিতীয় সাত বছর অর্থাৎ ৭ থেকে ১৪ বছর বয়সকালে শিশু যেসব শিষ্টাচার শিখবে, তা কিশোর ও যৌবনকালে তার চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্য গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। শিশুর জ্ঞান-বুদ্ধি, স্মৃতিশক্তি, মেধার বিকাশ এবং শেখার গতি এ সময় খুব প্রখর থাকে। প্রাপ্ত বয়সে তার মানবিক বোধ, আবেগ-অনুভূতি, আচার-আচরণগত বৈশিষ্ট্য এই দ্বিতীয় সাত বছরের শিক্ষারই ফলাফল। ইসলামের আচরণ পদ্ধতি ও শিষ্টাচার সম্পর্কে হাদীসে যেসব বর্ণনা বা নির্দেশনা এসেছে, শিকদের উচিত কাসে ছাত্রদের সামনে সেই সব আচরণ পদ্ধতি কৌশলে, গল্পাকারে বা অন্য যেকোন আকর্ষণীয় উপায়ে বর্ণনা করা, যাতে কোমলমতী শিশু-ছাত্ররা সে সব শিখে তাদের স্বভাবগত উৎসাহেই নিজের জীবনে কাজে লাগাতে পারে।
দ্বিতীয় সপ্তবর্ষে কোমলমতী ছাত্ররা স্কুলে যেসব গুরুত্বপূর্ণ শিষ্টাচার শিখতে পারে বা শিকদের যেটা শেখানো উচিত তা সংক্ষেপে তুলে ধরছি। শিশুকে শেখানো যেতে পারে কী ভাবে সালাম করতে হবে, কীভাবে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হয়, আল্লাহর নামে সকল কাজ শুর করা, খাওয়ার নিয়ম, পানিয় বস্তু গ্রহণ করার নিয়ম, পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা, বাবা-মা ও মুরব্বীদের সম্মান করা, অন্যদের সাথে চলাফেরা বা মেলামেশার নিয়ম, কথাবার্তা বলার শালীনতা, ঘুমানোর পদ্ধতি, যেকোন কাজে অপরের অধিকার সংরণ করা। এছাড়া অজু করার নিয়ম, গোসল করার নিয়ম, নামায পড়া এবং দোয়া করার পদ্ধতির সাথে পরিচয় করানো যেতে পারে। তাকে রোযা রাখা, কোরআন পড়া, ভ্রমণে যাবার ক্ষেত্রে করণীয় এবং বন্ধুত্বের নিয়ম-শৃঙ্খলার বিষয়েও জ্ঞান দেয়া যেতে পারে। এই সব শিষ্টাচার বা নিয়ম-শৃঙ্খলা শেখানোর পাশাপাশি চারিত্রিক গুণাবলী ও উত্তম স্বভাব অর্জনের ক্ষেত্রেও শিশুকে দিক-নির্দেশনা দিতে হবে। তাকে সব ধরণের মন্দ কাজ থেকে দূরে রাখতে হবে, যাতে তার চরিত্রের ওপর ঐসব মন্দ কাজের প্রভাব পড়তে না পারে। এটাও দ্বিতীয় সপ্তবর্ষের একটি শিশুকে প্রশিক্ষণ দেয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। তাই শিশুকে সুন্দর ও যথার্থভাবে গড়ে তোলার জন্যে প্রথমতঃ নিজেরা প্রশিতি হবেন এবং তারপর শিশুদেরকে প্রশিক্ষণ দেবেন। মনে রাখতে হবে যথার্থ দিক-নির্দেশনার অভাবেই কিন্তু শিশুর ভবিষ্যত হয় বাবা-মায়ের অপ্রত্যাশিত। #  ৫ম পর্বসন্তানের ভবিষ্যৎ সুন্দরভাবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে জন্মের পর থেকেই তাকে কীভাবে প্রশিক্ষিত করতে হবে-সেই দিক-নির্দেশনা দেয়াই এ আলোচনার উদ্দেশ্য। অনেক বাবা-মা আছেন যারা সন্তানকে ভালোবাসেন ঠিকই, কিন্তু জানেন না শিশু প্রতিপালনের যথার্থ পদ্ধতি। মুরব্বীদের পরামর্শ অনুযায়ী সন্তানের তত্ত্বাবধান করে থাকেন তারা। কিন্তু সমস্যা হলো মুরব্বীদের পরামর্শ যদি বিজ্ঞান সম্মত হয়, তাহলে তো ভালই আর অবৈজ্ঞানিক বা মনগড়া হয়ে থাকলে তা শিশুর বেড়ে ওঠার স্বাভাবিকতায় বিঘ্ন ঘটাবে। তাই বাবা-মায়ের উচিত, শিশুর জীবন বিকাশের প্রকৃতি সম্পর্কে জানা এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া। আমরা শিশুর স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য এবং সে অনুযায়ী বাবা-মায়ের করণীয় সম্পর্কে কথা বলছিলাম। দ্বিতীয় সপ্তবর্ষে শিশুর আচরণগত বৈশিষ্ট্য এবং তাকে কী কী শিষ্টাচার এ বয়সে শেখাতে হবে তা এর আগের পর্বে উল্লেখ করেছিলাম। এবারের পর্বেও সে আলোচনা অব্যাহত রাখবো। সাত থেকে চৌদ্দ বছর বয়সে একটি শিশু স্কুলে যেসব আদব-কায়দা বা শিষ্টাচার শিখবে, সেগুলোকে সাথে সাথেই বাস্তবায়নের পরিবেশ তৈরী করতে হবে। এমনভাবে তাদেরকে শেখাতে হবে, যাতে তারা তাদের বাবা-মা বা অন্যান্য মুরব্বীদের সাথে কথাবার্তা বা আচার-আচরণ করতে গিয়ে সেসব শিক্ষাকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজে লাগায়। তাদেরকে যেসব শেখানো হয়, সেগুলোর ব্যবহারিক প্রয়োগ যদি না থাকে, তাহলে ঐসব শিক্ষা কোন কাজেই আসবে না। ফলে শিশুদের ব্যক্তিত্ব গঠনে এই সব শিক্ষা বা প্রশিক্ষণের কোন প্রভাবই পড়বে না। এ বয়সে শিশুর জীবনে যেসব চারিত্রিক ও নৈতিক গুণ দৃঢ় হওয়া উচিত কিংবা কোন কোন ক্ষেত্রে আচার-আচরণগত ত্রুটির সংশোধন হওয়া উচিত, সেগুলো সম্পর্কে এবার আলোচনা করা যাক।
এ বয়সে শিশুর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে যে গুণগুলো থাকা উচিত, সেগুলো হলো সততা ও সত্যকথা বলা, মিথ্যা কথা বলা থেকে বিরত থাকা, হিংসা বা ঈর্ষা করা থেকে বিরত থাকা, গীবত বা কারো অনুপস্থিতিতে দোষ বলে বেড়ানোর মতো শয়তানী আচরণ থেকে বিরত থাকা, ভালো কাজ করা এবং অন্যের উপকার করা, কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ কিংবা গুজব রটনা থেকে বিরত থাকা, প্রয়োজনীয় কথাবার্তা বলা এবং ফালতু কথাবার্তা বলা থেকে বিরত থাকা ইত্যাদি। এই যে কতগুলো নৈতিকগুণের কথা আমরা উল্লেখ করলাম এগুলো নিরন্তর অনুশীলনের ব্যাপার। বাবা-মা কে অসম্ভব সতর্কতার সাথে খেয়াল রাখতে হবে এবং এগুলোর ব্যতিক্রম নজরে পড়লেই তা সংশোধন করার যুক্তিযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। রেগে-মেগে ভয় দেখিয়ে কিছু করা ঠিক হবে না। এ বয়সে শিশুর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে আরো কিছু গুণের সমাবেশ ঘটা উচিত। যেমন, অন্যের প্রতি জুলুম বা অত্যাচার করা থেকে বিরত থাকা এবং অন্যদেরকে বিরক্ত করা বা যন্ত্রণা দেওয়া থেকে বিরত থাকা, অপচয় বা অপব্যয়মূলক কর্মকান্ড থেকে দূরে থাকা, কথা দিয়ে কথা রাখার গুরুত্ব উপলদ্ধি করা, অন্যদের সাথে একগুঁয়েমি বা জেদি মনোভাব পোষণ করা থেকে বিরত থাকা, দান করা, দয়াশীল ও উদার হওয়া, মা ও মহানুভবতা দেখানো, নিজ ও অন্যান্যদের ব্যাপারে যথার্থ বিচারবোধ জাগা, জালিমের শত্রু এবং মজলুমের বন্ধু হওয়া এবং সর্বাবস্থায় আল্লাহর স্মরণ নিজের মধ্যে জাগ্রত রাখা।
এখন কথা হচ্ছে এইসব গুণাবলী কি শিশু প্রাকৃতিকভাবেই অর্জন করবে? না, শিশুকে এসবের ব্যাপারে যথার্থ প্রশিক্ষণ দিতে হবে। যখনি শিশু এইসব গুণাবলীর বিপরীত আচরণ করবে, তখনি বাবা-মায়ের উচিত হবে
মনস্তাত্ত্বিক পরিচর্যার মাধ্যমে শিশুকে এমনভাবে সেগুলো সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান দেওয়া যাতে শিশু বিরক্ত না হয় কিংবা বাধ্য না হয়। জোর করে কোন কিছু শেখালে শিশুর মনে বাবা-মা ভীতি কাজ করবে। ফলে প্রশিক্ষণ দেওয়ার মূল ল্যই ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ধরা যাক বাবা-মা যদি শিশুকে কোন কথা দিয়ে না রাখে, তাহলে শিশুও তা করতে শিখবে। ফলে শিশুকে শেখানোর আগে গুণগুলো বাবা-মায়ের ভেতরে অর্জিত হওয়া প্রয়োজন। একটি কথা ভুলে গেলে চলবে না, তাহলো ৭ থেকে ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত একটি শিশু আনুগত্যের পর্যায় অতিক্রম করে। অর্থাৎ এ সময় বাবা-মা, মুরব্বী, শিক তথা শ্রদ্ধেয়দের কথা মেনে চলাই হলো শিশুর প্রধান কর্তব্য। এটা একটা কঠিন পর্যায়। শিশুর জন্যেও কঠিন, অভিভাবকদের জন্যেও কঠিন। শিশুর জন্যে কঠিন, কারণ সর্বাবস্থায় শিশুর কাজ হলো আনুগত্য করা। আর বাবা-মা বা অভিভাবকদের জন্যে কঠিন, কারণ শিশু এ সময় বাবা-মা বা মুরব্বীদেরকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করবে। ফলে বাবা-মা, শিক-অভিভাবকদের অবশ্যই আদর্শস্থানীয় হতে হবে।
এখন কথা হলো, একটি শিশু যদি কোন মুরব্বী সম্পর্কে কিংবা ধরা যাক তার কোন শিক সম্পর্কে বাবা-মায়ের সামনে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্ল করে, আর বাবা-মা যদি তা শুনে মজা নেয়, তাহলে পরিণতিটা কী হবে? পরিণতি দাঁড়াবে এই-শিশুটি ঐ শিককে আর শ্রদ্ধা করবে না। ফলে পড়ালেখা থেকে তার মন উঠে যাবে। অন্যদিকে শিক সম্পর্কে কথা বলার অভ্যাস যেহেতু হয়ে গেছে, তাই ধীরে ধীরে অন্যদের ব্যাপারেও কথা বলতে অভ্যস্ত হয়ে পড়বে পরিণতিতে এই শিশু ভবিষ্যতে বাবা-মায়ের অবাধ্য হয়ে যেতে পারে। বাবা-মাকে তাই সতর্ক থাকতে হবে। পাশাপাশি শিকদেরও উচিত শিশুদের মনস্তত্ত্ব বোঝা এবং নিজেদের ব্যক্তিত্ব বজায় রেখে শিশুদের সাথে আচরণ করা। সর্বোপরি নিজেদের মেধা কাজে লাগিয়ে শিশুদের মন জয় করা।
শিশু জীবনের প্রথম সপ্তবর্ষ হলো স্বাধীনতার পর্যায়। সাত-সাতটি বৎসর স্বাধীনতা ভোগ করার পর একটি শিশু আনুগত্যের পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছে। দ্বিতীয় সাত বছর আনুগত্য করার ফলে শিশুর জীবনের এখন কিছুটা দায়িত্ব জ্ঞান, নৈতিকতাবোধ জেগেছে। শিশু যদি যথার্থভাবে তার আনুগত্যের পর্যায় অতিক্রম করে থাকে, তাহলে শিশুটি এখন এমন কিছু মেধা ও জ্ঞান-বুদ্ধি অর্জন করতে সম হয়েছে যা দিয়ে সে তার মুরব্বীদেরকে কাজে-কর্মে সহযোগিতা করতে পারে । এভাবেই শিশুটি তার জীবনের তৃতীয় সপ্তবর্ষে এসে পৌঁছুবে । এ পর্যায়টি শিশুর দায়িত্বশীলতার পর্যায়, বাবা-মা বা পরিবারকে বুদ্ধি পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করার পর্যায় । ফ্রান্সের একজন বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব মৌরীস রব্সের একটি উক্তির মধ্য দিয়ে এ পর্বের আলোচনা শেষ করবো। তিনি বলেছেন প্রতিটি ঘরের দরোজা হয়ে উঠুক শিক উন্মুখ, আর প্রতিটি বিদ্যালয়ের দরজা পরিবারের জন্য উন্মুক্ত হয়ে থাকুক। আমরা চাই এককভাবে কোন স্কুল বা কোন পরিবার যেন একটি শিশুর পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ না করে। অর্থাৎ গৃহ এবং স্কুল পরস্পরের পরিপূরক হয়ে উঠুক। এ উক্তির ব্যাখ্যা এভাবেও করা যেতে পারে যে, শিশুকে স্কুলে পাঠিয়ে দিয়েই বাবা-মা যেন এরকম মনে না করেন যে তাদের দায়িত্ব শেষ। আবার বাসায় শিশুকে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েই যেন কেউ এরকম না ভাবেন যে তাকে আর স্কুলে পাঠানোর দরকার নেই। আমরা এসব ব্যাপারে যৌক্তিক হব, সচেতন হব-এ কামনা করছি।

Facebook Comments