এমন এক সময় ছিল যখন আফগানিস্তানের নারীদের লোকসমাগমে প্রায় দেখাই যেত না। এমনকি নেতাদের স্ত্রীদেরও নয়। হয়তো কদাচিৎ কোনো কারণে এমন পরিবেশ বা অবস্থায় কোনো নারীর দেখা মিললেও তারা থাকতেন আবরু রক্ষা করে। মনে করা হতো, এটি আফগানিস্তানের ঐতিহ্য। এমনকি একসময়ে দেশটির ফার্স্ট লেডিও এমন রীতিকে স্বাগত জানাতেন। তবে ক্রমে দেশটির সমাজে এ ধ্যানধারণায় পরিবর্তন আসতে থাকে। এমন পরিবর্তনের পক্ষে নানা মত প্রকাশ করেন দেশটির নতুন ফার্স্ট লেডি রুলা গনি। এসব ব্যাপারে তিনি গণমাধ্যমের সামনেও কথা বলেন।
রুলা বলেন, দেশটির নারীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনে আমাদের আরো সচেষ্ট হতে হবে। এ ব্যাপারে আমি সবাইকে উৎসাহিত করতে চাই। নারীদের চলার পথে নানা ভালো সুযোগ করে দেয়া গেলে তাদের জীবনে অগ্রগতি আসবে। রুলা গনি মনে করেন, নানা কুসংস্কারের দেয়াল ভাঙতে প্রয়োজন ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা ও জনসমর্থন। এ জন্য উপযুক্ত সময় প্রয়োজন। নির্বাচনী প্রচারণার সময় এমন সুযোগ কাজে লাগালে ভালো ফল আসতে পারে। সেই ইচ্ছাও তার পূরণ হয়। চলতি বছর (২০১৪) অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আশরাফ গনির নির্বাচনী প্রচারণায় রুলা জনসম্মুখে উপস্থিত থেকে এ সংক্রান্ত নানা কথা বলেন। এ দিকে আশরাফ গনিও নিজের অভিষেক অনুষ্ঠানে এক আবেগময় বক্তৃতা দেন। এটি ছিল মূলত স্ত্রী রুলা গনির উদ্দেশে। আর তখনই রুলা পরিণত হন গোটা দেশের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে। রুলা খুশির সাথে বলেন, আমার স্বামী (আশরাফ গনি) আমাকে সবার সামনে যেভাবে উপস্থাপন করেছেন, তাতে এটাই বোঝা যায় যে আমি আফগানিস্তানের মেয়েদের আরো সচেতন হতে অনুপ্রেরণা জোগানোর কথা বলতে চাই। তবে তিনি যা করতে চাইছেন তা মোটেই সামাজিক ঐতিহ্য ও মূল্যবোধের বিপরীত বা সাংঘর্ষিক নয়। অর্থাৎ বর্তমান সমাজের ব্যাপক পরিবর্তনের কথা বলা হচ্ছে না। রুলা গনি বলেন, আমি পশ্চিমে বড় হয়েছি ঠিকই, তবে সেখানাকার সমাজের রক্ষণশীলতার মনোভাব আমাকে প্রভাবিত করতে পারেনি মোটেই; বরং এসব দেশে থেকে এসংক্রান্ত অনেক শিক্ষা বা ধারণা হয়েছে আমার। তবে আমার যেটুকু কষ্ট তা হলো আমার পুরো পরিবারকে আমি একসাথে পাইনি। তারপরও মনে করি, সৃষ্টিকর্তা আমাদের ভালোই রেখেছেন। আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে তখনই যখন দেখি আমার কথা, উপদেশ, পরামর্শ ইত্যাদি মানুষ মনোযোগ সহকারে শুনছেন। আর মনোযোগ সহকারে শোনা মানেই এসবের প্রতি গুরুত্ব দেয়া। দীর্ঘ প্রায় ২৫ বছরের গৃহযুদ্ধের কারণে দেশটির (আফগানিস্তান) অবকাঠামো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
তারপরও এখনো অনেক শক্ত আছে রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক অনেক দিক। আর এটিই হচ্ছে বিরাট ইতিবাচক দিক। রুলা গনির জন্ম লেবাননের এক খ্রিষ্টান পরিবারে। সেখানেই তার বেড়ে ওঠা। রাজধানী বৈরুতের যুক্তরাষ্ট্র ইউনিভার্সিটিতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পড়াশোনা করেন ১৯৭০-এর দিকে। পড়াশোনার ফাঁকে পরিচয় ঘটে আশরাফ গনির সাথে। রুলা প্রায় এক বছরের পড়াশোনা করে বৈরুতে যান। প্রতিষ্ঠানটি ছিল ফ্রান্সের প্যারিসের সায়েন্সের পো ইনস্টিটিউট। এক সময় ছাত্র আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন তিনি। এমনকি এক বিক্ষোভে গ্রেফতারও হন রুলা। তারা দু’জন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান ১৯৭০-এর শেষের দিকে। সেখানেই আশরাফ গনি শেষ করেন পিএইচডি। আর ক্যারিয়ার শুরু করেন বিশ্বব্যাংকে। তারা দুই সন্তানের বাবা-মা। ছেলে তারেক উন্নয়ন গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। আর মেয়ে মরিয়ম ভিডিও আর্টিস্ট হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন। তারা খুবই গর্বিত নিজেদের সংস্কৃতি আর ঐতিহ্য নিয়ে। বলা যেতে পারে মা রুলার দেখাশোনার কারণে নিজ সন্তানেরাও ব্যাপক পরিচিতি ঘটাতে পেরেছেন দেশে। রুলা গনি নারীদের পাশাপাশি শিশুদের উন্নয়নেও কাজ করেন। বিশেষ করে যুদ্ধবিধ্বস্ত শিশুরা যেন স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে সে জন্য তাদের (শিশু ও মায়েদের) নানাভাবে সাহায্য সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন। রুলা মাঝে মধ্যেই আফগানিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশে ঘুরে বেড়ান এবং সেখানকার লোকেদের সাথে তাদের নানা সমস্যা নিয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, ভবিষ্যতের জন্য ভালো কিছু করা খুবই জরুরি। অনেক সাধারণ নারী আছেন যারা সমাজে মিশে প্রচুর কাজ করেন। রুলা মনে করেন, দেশটি যুদ্ধবিধ্বস্ত হলেও সামাজিক কাঠামো এখনো যথেষ্ট শক্ত আছে। এর ওপর ভর করেই অনেক দূর এগিয়ে যাওয়া মোটেই কঠিন নয়। রুলা গনি আফগানিস্তানে ফিরে আসেন তার (রুলা) বিয়ের পর। বসবাস করতে থাকেন কাবুলে। এর বছর তিন পর আশরাফ গনি কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। এর ফাঁকে সিদ্ধান্ত নেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যানথ্রোপলজিতে ডক্টরেট ডিগ্রি নেবেন। তারা দুই বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানে সোভিয়েত হস্তক্ষেপ ও অভ্যুত্থানে তাদের সব কিছু পাল্টে যায়।
বিভিন্ন যুক্তিতে তাদেরকে ফেরত না আসতে বলা হয়। রুলা বলেন, আমার স্বামীর পরিবারের অনেক সদস্য পুল-ই চারখি কারাগারে বন্দী ছিল এবং ভয় ছিল যে আমরা ফেরত এলে তাকেও (আশরাফ) কারাগারে নিক্ষেপ করা হবে। সুতরাং আমরা যুক্তরাষ্ট্রেই থেকে যাই, যে থাকা দুই বছরের স্থলে টানা প্রায় ৩০ বছর হয়ে যায়।
সূত্র- নয়া দিগন্ত
Facebook Comments