ময়মনসিংহের একজন সফল নারী উদ্যোক্তা আইনুন্নাহার। ২০০৩ সালে একটি সেলাই মেশিন নিয়ে শুরু করেছিলেন সেলাই কাজ। ১৩ বছরের পথচলায় তিনি এখন নারী উদ্যোক্তা হিসেবে অনেকের আদর্শ। আইনুন্নাহারের নিজের কাজের পরিধি দেশের সীমানা ছাড়িয়ে গিয়েছে। তাঁর উদ্যোগের জন্য তিনি অর্জন করেছেন স্বীকৃতি ও সম্মাননা।
২০০৩ সালে আইনুন্নাহার যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের অধীনে সেলাই প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণে প্রথম হয়ে তিনি একটি সেলাই মেশিন পান। ময়মনসিংহ শহরের ভাড়া বাড়িতে শুরু করেন সেলাই কাজ। প্রথমে পরিবার, স্বজন ও প্রতিবেশীদের পোশাক তৈরি করে দিতেন। টাকাপয়সার চিন্তা মাথায় খুব বেশি ছিল না। কেউ খুশি হয়ে যা দিত তাতেই খুশি। ইচ্ছা ছিল বড় কিছু করার। এভাবে কেটে যায় চার বছর। চার বছরে আইনুন্নাহারের সেলাইয়ের কথা ছড়িয়ে পড়ে শহরের বিভিন্ন এলাকার নারীদের মধ্যে। আসতে শুরু করে নারী ও শিশুদের পোশাকের কাজের ফরমাশ। একা তিনি করতে পারছিলেন না। দরকার কয়েকজন কর্মী। আইনুন্নাহার কর্মী নিয়োগ না নিয়ে ২০ জন নারীকে নিয়ে নিজের বাড়িতেই আয়োজন করেন প্রশিক্ষণ। তিন মাসের বিনা মূল্যে প্রশিক্ষণ শেষে ৫ জনকে রেখে দেন নিজের সঙ্গে।
প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চারজনকে নিয়ে শুরু হয় আইনুন্নাহারের বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পোশাক তৈরি। ক্রমে বাড়তে থাকে কাজের পরিধি। নারী ও শিশুদের জন্য পোশাক তৈরি করে প্রথমে ময়মনসিংহের বিভিন্ন দোকানে সরবরাহ করতে শুরু করেন। এর মধ্যে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত পোশাক তৈরির কাজ পেয়ে যান। বেড়ে যায় তাঁর কর্মী ও কাজ।
২০০৯ সালের ময়মনসিংহের উন্নয়ন সংস্থার আসপাডা পরিবেশ উন্নয়ন সংস্থার পরিচালক আবদুর রশিদ একদিন আইনুন্নাহারের কাজ দেখে মুগ্ধ হন। তিনি বিনা সুদে ৫০ হাজার টাকা ঋণ দেন। পরে আইনুন্নাহার শুরু করেন নারী কর্মী তৈরির কাজ। আয়োজন করেন প্রশিক্ষণের। এরপর থেকে প্রতিবছর চলে চারটি ব্যাচের প্রশিক্ষণ। প্রতি ব্যাচে ৩০ জন করে নারী বিনা মূল্যে সেলাই ও বুটিকের কাজের প্রশিক্ষণ পাচ্ছেন।
২০১৩ সালে নারী উন্নয়ন অধিদপ্তরের নিবন্ধন নিয়ে আইনুন্নাহার প্রতিষ্ঠা করেন তৃণমূল নারী উন্নয়ন সমিতি। বর্তমানে এই সমিতির মাধ্যমে নিয়মিত চলে নারীদের সেলাই প্রশিক্ষণ। প্রতিবছর বের হয়ে আসছেন অনেক দক্ষ নারী কর্মী। যাঁরা পরবর্তী সময়ে নিজেরাই উদ্যোক্তা হয়েছেন। আইনুন্নাহারের রয়েছে তৃণমূল কারুপণ্য নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এখানে তৈরি হয় ব্লক ও বুটিকের পোশাক। ময়মনসিংহ ছাড়াও ঢাকার রাপা প্লাজায় ‘জয়িতা’ নামের রয়েছে তাঁর একটি দোকান। রয়েছে ওই সব পণ্যের চাহিদা। দেশের বিভিন্ন মেলায় উদ্যোক্তা হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। দেশের বাইরে ভারতে দুবার, নেপালে একবার মেলায় স্টল নিয়েছে আইনুন্নাহারের তৃণমূল কারুপণ্য। চলছে চীনের মেলায় অংশ নেওয়ার প্রস্তুতি। বর্তমানে আইনুন্নাহারের অধীনে কাজ করছেন ১৬০ জন নারী ও পুরুষ।
উদ্যোক্তা হিসেবে ১৩ বছর কাজ করে পেয়েছেন বিভিন্ন সম্মাননা ও স্বীকৃতি। উল্লেখযোগ্য পদকগুলো হলো ২০১০ সালে সফল উদ্যোক্তা হিসেবে যুব উন্নয়ন থেকে পুরস্কার ও সম্মাননা। ২০১৩ সালে ময়মনসিংহ সদর উপজেলা, ময়মনসিংহ জেলা ও ঢাকা বিভাগীয় পর্যায়ে ‘জয়িতা’ পুরস্কার লাভ। এ ছাড়া স্থানীয় পর্যায়ে তিনি উদ্যোক্তা হিসেবে পেয়েছেন বেশ কিছু পুরস্কারের স্বীকৃতি। নারীদের দক্ষ কর্মী ও উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন নারী উন্নয়ন ফোরাম। বর্তমানে এটির নিবন্ধন-প্রক্রিয়া চলমান আছে। আইনুন্নাহার বলেন, ‘পড়াশোনা শেষে ইচ্ছা ছিল, চাকরি না করে নিজে কিছু করব। পাশাপাশি আমাদের সমাজের নারীদের কর্মী হিসেবে স্বাবলম্বী করা যায় এমন ভাবনা ছিল। সেই চিন্তা নিয়ে আস্তে আস্তে আমি অগ্রসর হয়েছি। নারী উন্নয়ন ফোরাম করে আমি নারীদের উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে ব্যাংক লোনসহ অন্যান্য সুবিধা দেওয়ার জন্য কাজ করব।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমার পথচলায় স্বামী খোন্দকার ফারুক আহমেদসহ অনেকের অকৃত্রিম সহযোগিতা থাকায় কাজ করতে সুবিধা হয়েছে।’
আইনুন্নাহার: সফলতার আদর্শ
Facebook Comments