আফরোজা হাসান
মাঝে মাঝে মনে হয় প্রত্যেকটি মনই এক একটি সাম্রাজ্য। আর মনটিকে ধারণকারী ব্যক্তি সেই সাম্রাজ্যের সম্রাট। আর মনের অনুভূতিগুলো সেই সম্রাটের মন্ত্রী-উজির-নাজির-প্রজা-সৈন্য। সাম্রাজ্যের সকল কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হবার জন্য যেমন সম্রাটের মন্ত্রী-উজির-নাজির-প্রজা-সৈন্যদের সাহায্য সহযোগিতা প্রয়োজন, মনোজগতের ক্ষেত্রেও কিন্তু ঠিক তাই। অনুভূতিগুলোকে সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে বিঘ্নিত হয় মন সাম্রাজ্যের কার্যাবলী।
মানবিক অনুভূতিগুলোকে কখনোই ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। ফুলের সৌরভের মত এগুলো শুধুই অনুভবের। কবি সাহিত্যিকরা যদিও উপমা বা রূপকের মাধ্যমে অনুভূতিগুলোকে প্রকাশ করতে চেষ্টা করেছেন। যেমন, ফুলের মত কোমল(কোমলতা), পাহাড়ের মত অনঢ়(অনঢ়তা), চাঁদের মত স্বিগ্ধ(স্বিগ্ধতা), হায়নার মত হিংস্র(হিংস্রতা), শেয়ালের মত ধূর্ত(ধূর্ততা)ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে এই উপমা বা রূপকের দ্বারাও আসলে অনুভূতিগুলো ব্যক্ত হয় না বরং অনুভবই করা হয়।
যাইহোক, মন সাম্রাজ্যের সম্রাটের মন্ত্রী-উজির-নাজির-প্রজা-সৈন্যরা হচ্ছে অনুভূতিরা। কিন্তু কোন অনুভূতি কোন পদে আসন সেটা কি জানি? মন্ত্রীর আসনটা চিন্তা করার সাথে সাথেই মনেহলো সম্রাটের পাশে মাথা উঁচু করে বসে আছে ‘অহং’। আর সামনে হাঁটু গেঁড়ে মাথা নিচু করে বসে আছে অভিমান। অহং এর নাক ভীষণ উঁচু তাই মাঝে মাঝেই তর্জনী ঘষে তা দিয়ে যাচ্ছে নাকের ডগায়। আর অভিমান নাক টেনে টেনে রাশ টেনে ধরতে চেষ্টা করছে লাগামহীন অশ্রুর।
অহং আর অভিমানের মধ্যে পার্থক্য কি? যখন ভাবছিলাম মনের অভিধানে উল্লেখিত কথাগুলোর সন্ধান পেলাম। অহং আর অভিমান কখনোই এক না। কারণ এই দুটিই ভিন্ন দুটি মানসিক অনুভূতি। অভিমান হচ্ছে মনের কোনে লুকিয়ে থাকা ছোট্ট শিশুটি। যে কথায় কথায় গাল ফুলিয়ে বসে যায়। কনিষ্ঠা আঙ্গুল উঁচিয়ে বলে আড়ি আড়ি আড়ি। আর অহং হচ্ছে সেই স্বৈরাচারী সত্তা যে নিজেকে অন্যের থেকে শ্রেষ্ঠ ও উত্তম মনে করে পায়ের উপর পা তুলে বসে থাকে। যে যাই বলুক পা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে প্রদর্শন করে বৃদ্ধাংগুলি।
অভিমানকে আমার মনেহয় ঋতু পরিবর্তনের সময়কার উষ্ণতা ও শীতলতার সংমিশ্রণের আদুরে জ্বর। নাকে সর্দির বন্যা, গলায় খুকখুক ধ্বনি। রেশমি শালে জড়িয়ে, পশমি মাফলার গলায় ঝুলিয়ে, হাতে ধরিয়ে দিতে হয় একমগ মসলা চা। এতোই আহ্লাদী অভিমান। আর অহং মারাত্মক কোন মরণব্যাধি। এইডস, ক্যান্সার নাকি ডায়াবেটিস? হ্যা ডায়াবেটিস। একবার মনে বাসা বেঁধে ফেললে আর মুক্তি নেই। সবসময় তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। বেড়ে গেলেও বিপদ আবার কমে গেলেও বিপদ। এ যেন জলে কুমীর আর ডাঙ্গায় বাঘ অবস্থা।
অভিমানের পেছনে লুকায়িত থাকে ভালোবাসা+ অনুযোগ+ অভিযোগ+ প্রত্যাশা-আশা-আকাঙ্ক্ষা, অর্থাৎ প্রাপ্তির আশা+ বিশ্বাস ও ভরসার অবমূল্যায়ন প্রসূত রাগ+ পছন্দ-অপছন্দের বিভেদ জনিত রাগের অভিনয় ইত্যাদি। আর অহং এর পেছনে থাকে নিজের কোন কিছুকে উপরে তুলে ধরে অন্যদের কাছে নিজেকে উপস্থাপন বা পেশ করা। যার উদ্দেশ্য থাকে অন্যকে অবমূল্যায়ন করা বা হেয় করা। এবং নিজেকে অন্যদের থেকে শ্রেষ্ঠ মনে করে আনন্দিত হওয়া।
সুতরাং, অহং ও অভিমান কখনোই একই অনুভূতি নয়। এই দুই অনুভূতিতে যোজন যোজন পার্থক্য বিরাজমান। তবে হ্যা অভিমানের পথ বেয়ে মনে অহং ঢুকে যাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু না। অভিমানের উপর যখন অবিরাম তুষার ঝরতে থাকে এবং পরশ পায় না সে রোদের। ধীরে ধীরে একসময় তা বরফের পাহাড়ে রুপান্তরিত হয়ে যায়। তখন সূর্যিমামার প্রখর কিরণও খুব সহজে সেই পাহাড়ের বুকে বইয়ে দিতে পারে না ঝর্ণাধারা।
আসলে মনের অনুভূতিগুলোর সাথে আমাদের স্বার্থ জড়িত। জড়িত আমাদের আত্মতৃপ্তি, বাসনা, সন্তুষ্টি। অহংকার ও আসক্তিমুক্ত, বিবেকবোধ সম্পন্ন, পরমার্থজ্ঞাননিষ্ঠ, জীবনের সুখ-দুঃখের অবস্থানকে ঘিরে নিয়তি প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসী মানুষের পক্ষেই কেবল সম্ভব স্বার্থ নির্ভর না হওয়া। আর একজন মানুষকে নিজকে স্বার্থহীন হিসেবে গড়ে তোলার জন্য যে পথে হাঁটতে হবে তার নাম শরীয়ত। যখন মনে আল্লাহর অবস্থান নির্দিষ্ট হয়ে যায় ব্যক্তি পারিপার্শ্বিক শত প্রতিকূলতার মাঝেও করে যেতে পারে অনুভূতির সঠিক প্রয়োগ।
আমি বিশ্বাস করি যে, শুধু যদি অহং বিসর্জন দেয়া যায় তাহলেই পৌছানো যায় মন সাম্রাজ্যের সেই কুটিরটিতে যার নাম প্রশান্তি। আর অভিমান? উহু সে থাকুক সঙ্গোপনে, মনে মনে, নীরবে-নির্জনে, একান্ত আপনে। অভিমান তো সেই অলংকার যা বন্ধনকে করে আরো রঙিন। কিছুটা বিষণ্ণ, সামান্য অবসন্ন, একবিন্দু বিরক্তি, অজানা আসক্তি, করে নিজের সাথে চুক্তি, এসব থেকে নেয়া যায় যদি মুক্তি। মনে বিরাজ করবে প্রশান্তি, অভিমানের এতটাই এই শক্তি………।