ডা. তাজুল ইসলাম
মসজিদে গেলে সেখানে সামাজিক যুদ্ধ চলে কার ছেলে/মেয়ে কত ভালো করছে, কোথায় চান্স পেয়েছে, যখন ক্লাশে ফার্স্ট হতে শুরু করলাম বাবাসহ সবাই বলতে লাগলো অন্য ছেলেরা কম পড়েছে তাই তুমি ফার্স্ট হয়েছ।
কাহিনী সংক্ষেপ :রোগীর মা বলেন স্যার দিনাজপুর থেকে এসেছি –
বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ নিউরোলজিস্ট দ্বীন মোহাম্মদ স্যার আমার সব কথা শুনে তাৎক্ষনিভাবে আপনার ঠিকানা দিয়ে বলেন এখনি ওনার কাছে চলে যান।
মা,খালা ও রোগী আজমি যা বললেন :
বাবা একটি সরকারী স্কুলের প্রধান শিক্ষক, মা প্রাইমারী স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। আজমির বাবা গ্রাম থেকে উঠে আসা ব্রিলিয়্যান্ট ছাত্র। বোর্ডে স্টান্ড করা। দারিদ্র ও পারিপার্শ্বিকতা কারনে তিনি পরবর্তীতে তত ভালো করতে পারেননি।
তাই তিনি এখন তার অপূর্ণ স্বপ্ন একমাত্র ছেলেকে দিয়ে পূরণ করতে চান। ছেলেকে সব সময় কন্ট্রোল করা ও আগলে রাখার চেষ্টা করেন। প্রতিদিন ভোরে উঠার জন্য ১ বার, দুপুরে খাবার ব্রেকে ১ বার ও বিকেলে হাটতে গেলে ১ বার ফোন করবেনই।
যদি ফোন রিসিভ না করে তাহলে ১৫-১৬ বার ফোন করতে থাকে( বলে তোমার কিছু হলে আমি বাঁচবো না)।
পড়ার সময় আত্মীয় স্বজন এলে বলে ওর কাছে যেও না ওর পড়ার ডিস্টার্ব হবে, কিন্তু নিজে ছেলের পাশে বসে স্কুলের নানাবিধ সমস্যার কথা ছেলের কাছে শেয়ার করে।
বন্ধুদের বার বার ফোন করে জানতে চায় আজমি ক্লাশে আছে কিনা, কোথায় খাচ্ছে, কি খাচ্ছে। এতে বন্ধুরা মজা পেয়ে তারা বলে আঙ্কেল ও তো ক্লাশ করে না, বাজে হোটেলে খায় ইত্যাদি।
এভাবে ওনার টেনশন আরো বাড়িয়ে দেওয়া হয়। ছুটির দিনও হল থেকে বাসায় আসতে মানা করে কেন না এতে পড়াশোনার ক্ষতি হবে। সারাক্ষণ খবরদারি করতো টিভি দেখো কেন, এটা করা যাবে না, ওটা করা যাবে না ইত্যাদি।
বানান ভুল করলে মারধর করতো। বলতো ওমুকের ছেলের রোল ১ বা ২ আর তুমি সবসময় ৮-৯ এ থাকো।
আজমি বলে ক্লাশ সিক্স এ উঠার পর আমার রেজাল্ট ভালো হতে থাকে। আমি ফার্স্ট হতে শুরু করি। কিন্তু বাবাসহ অন্যরা বলে বাকী সবাই তেমন পড়াশুনা করে নাই, তাই তুমি ফার্স্ট হয়েছো। সন্ধ্যার পর কোন আড্ডায় যাওয়া নিষিদ্ধ। তুলনা করে বলে পাশের বাড়ীর মেয়েটি স্কলারশিপ পেয়েছে, ওমুকে তেমন করেছে। এরকম তুলনা করলে মন খারাপ হতো।
আজমি আরো বলে, স্যার মসজিদে নামাজ পড়ার পর এক সামাজিক যুদ্ধ বাঁধে- সবাই বড় গলায় বলতে থাকে কার ছেলে/ মেয়ে কত ভালো রেজাল্ট করেছে বা কত ভালো জায়গায় ভর্তি হতে পেরেছে। এগুলো বাবার মনে জিদ তৈরি করে, আমার ছেলে পিছিয়ে থাকবে কেন?
আজমির সমস্যা শুরু ৫ বছর আগ থেকে যখন সে ক্লাশ টেনে পড়ে। এক সময় সে লক্ষ করে লিখতে গেলে তার আঙ্গুল শক্ত হয়ে যায়, লিখতে অসুবিধা হয়। তবে নিজেই মনের জোরে চেষ্টা করে ভালো হই। আড়াই বছর পর আবার এ সমস্যা দেখা দেয় যখন এইচএসসি পরীক্ষার ২ মাস বাকী। একই সঙ্গে অতিরিক্ত স্বপ্ন দোষ হতে থাকে।ডাক্তার বলে এগুলো নরমাল।
আরো সমস্যা যোগ হয়- ঘাড় ভার হয়ে আসে, যেন কেউ একজন ঘাড়ে বসে আছে। এই ভারে হাটতে গেলে মাথা নিচু হয়ে যেতো। পড়তে গেলে মাথা জ্বলে।
একদিন দেখি পুরো ঘরে ধোয়ায় ভরা,একটি লোকের লম্বা আঙ্গুল আমার গলা চেপে ধরতে আসছে। আমি পা দিয়ে খাটে আঘাত করি যাতে শব্দ শুনে কেউ আসে। তারা আমার পা ও চোখ চেপে ধরে। আয়াতুল কুরসি পড়তে থাকি।কিছুক্ষণ পর সব পরিষ্কার। এর সঙ্গে আরেক সমস্যা শুরু হয়, কে যেন বলে আমি জানালার পাশে আছি, তোকে মেরে ফেলবো।
মনে হয় কে যেন পা ধরে টানে,মনে হয় বাতাসে উড়ে বেড়াচ্ছি। এসব কারনে পড়া শুনা বন্ধ হয়ে যায়। খালাতো ভাই হুজুর আনে। তিনি অন্য একজনের উপর জ্বীন ঢেকে আনেন। সে বলে তাবিজ আছে, জ্বীন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। এসব বলে হুজুর বলে ওকে আর ঝামেলা করবেন না। এরপর হাত ঠিক হয়ে যায়। পরীক্ষার আর মাত্র ৩ দিন বাকি। তবু ও পড়া শুরু করি। পরীক্ষার আগের দিন কাউকে চিনি না, উদভ্রান্ত হয়ে পড়ি। সকালে ৪ জনে ধরে নিয়ে হলে বসিয়ে দেয়( বাবা চান না ইয়ার লস হোক)। ম্যাডাম বলে যা পারো লেখো।
৫ বার উঠি,ম্যাডাম প্রতিবার বসিয়ে দেয়( যেহেতু বাবা বলে গেছে)। সে পরীক্ষায় ৮৬% এন্সার করে ৮২% মার্ক পেয়েছিলাম।
পরের দিন পরীক্ষা দেবো না। তখন নিউরোলজিস্ট দেখানো হয়। তিনি সিটি স্ক্যান করে বলেন কোন সমস্যা নাই। তবু পরীক্ষা দেই। বন্ধুরা, বিশেষ করে মেয়েগুলো বলতে থাকে বেশী বেশী পড়তো বলে আজ এ অবস্থা।
প্রতিটি পরীক্ষা দেই আর হাতের সমস্যা তত বাড়তে থাকে। শেষ দিন হাতের আঙ্গুল একেবারে বেকে যায়, কোন রকমে টেনে টেনে লিখা শেষ করি। এরপর খালার বাসায় নিয়ে অন্য হুজুর দেখানো হয়। তিনিও একই কথা বলেন। এরপর হাতের সমস্যা কমে যায়।
খালা বলে স্যার ওর সমস্যা দেখা দিলেই হুজুরকে ফোন করে, আর হুজুর টাকা চায়। এভাবে অনেক টাকা দেওয়া হয়ে গেছে। এরপর ভার্সিটির এডমিশন টেস্ট। সেখানেও কষ্ট করে পরীক্ষা দেই।তবু বি- ইউনিটে ৩৪ তম হয়ে ঢাকা ভার্সিটিতে’ল সাবজেক্টে ভর্তি হই( জগন্নাথে ২১ তম হই)।
এরপর হাতের সমস্যার জন্য অর্থোপেডিক ডাক্তার দেখাই। একজন বলেন ট্রিগার আঙ্গুলে সমস্যা কিন্তু পিজিতে বলে কোন সমস্যা নেই। কোনভাবে ফার্স্ট টার্ম দেই। সেকেন্ড টার্মের আগে আব্বুকে বলি দ্বীন মোহাম্মদ স্যারকে দেখাতে। ভালো হইনি। তখন ম্যাডামের অনুমতি নিয়ে ” রাইটার” নিয়ে ৬টি পরীক্ষা দিলাম।
এরপর অন্য সমস্যা দেখা দেয় ঘুমাতে যাই কে যেন পা টেনে অন্য দিকে নেয়, আঙ্গুল শক্ত করে দেয়, হাত- পায়ের রগ দিয়ে বাতাস ঢুকে আমাকে অস্হির করে তুলে, মনে হয় সবাইকে মেরে ফেলবো,ভাংচুর করবো। এবার দ্বীন মোহাম্মদ স্যারের কাছে গেলে সরাসরি আপনার কাছে পাঠিয়ে দেয়।
এ কাহিনী থেকে যা শিক্ষনীয়:
১। লিখতে গেলে আঙ্গুল শক্ত হয়ে গিয়ে লিখতে না পারার রোগের নাম ” writer’s cramp”।
২। এটি একটি উদ্বেগ জনিত রোগ হলেও মূলত যারা পারফেক্টশনিস্ট( অতিরিক্ত নিখুত হতে চায় ) তাদের এ সমস্যা বেশি দেখা দেয়।
৩। শিশু লালন পালন পদ্ধতি : মূলত ৪ ধরনের।তবে এখানে বাবা কে একাধারে অতি নিয়ন্ত্রণ ও অতি আগলে রাখার প্রব্ণতা দেখতে পাচ্ছি ( over control and over possessiveness)। এটি একটি মিশ্র পদ্ধতি। উভয় প্রবণতাই ক্ষতিকর।
৪। নিজেদের অপূর্ন স্বপ্ন সন্তানদের দ্বারা পূরণ করার অবাস্তব চেষ্টা তাদের উপর বাড়তি চাপ তৈরি করে।
৫। সারাক্ষণ অন্যদের সঙ্গে তুলনা করে আমরা সন্তানদের মনোবল ভেঙ্গে দেই,তাদের মনে হীনমন্যতা ঢুকিয়ে দেই।
৬। সামাজিক যুদ্ধ – কার ছেলে/মেয়ে কত ভালো করেছে- এটি আমাদের সমাজে একটি ব্যাধি হয়ে দাড়িয়েছে।জিপিএ-৫ এর নেশায় অভিভাবকরা মরিয়া হয়ে সন্তানদের পিছে লাগছে
৭। বাবার অতি নিখুত হওয়ার প্রবনতা আজমি পেয়েছে,অতি নিয়ন্ত্রণ, আগলে রাখার কারনে আত্মবিশ্বাস দুর্বল হয়েছে, অতি সামাজিক তুলনা ও সমালোচনায় হীনমন্যতা তৈরি হয়েছে,অতি প্রত্যাশা মনে আশঙ্কা তৈরি করেছে।
সব মিলিয়ে পরীক্ষা তার কাছে মূর্তিমান দৈত্য হিসেবে হাজির হয়- তার অবচেতন মন শঙ্কা ও উদ্বেগে ভারাক্রান্ত হয়।ফলে পরীক্ষার সামনে লিখতে গেলে তার ” রাইটারস ক্রাম্প” শুরু হয়।
৮। একই মানসিক দ্বন্দ্ব, সংঘাতের কারনে তার অবচেতন মনে অনেক চাপ পরে, যা তার ধারন ক্ষমতার বাইরে।
ফলে”dissociative- conversion”- রোগের লক্ষণ দেখা দেয়-
যার বেশীরভাগ লক্ষণকে আমাদের দেশে ” জ্বীন-ভুতে” ধরার লক্ষণ মনে করা হয়।
৯। মনে রাখতে হবে শুধু মেধা থাকলে হবে না,মানসিক জোর,আত্মবিশ্বাস ও থাকতে হবে।তানাহলে মেধা কোন কাজে আসবে না।
১০। যেহেতু মানসিক রোগ – তাই হুজুর ও ধর্ম বিশ্বাস -রোগীর মনে এই বিশ্বাস ও আস্হা তৈরি করে যে এবার সে জ্বীনের কবল থেকে মুক্ত হয়েছে,তাই সাময়িকভাবে সে লক্ষণ মুক্ত হয়( আমরা একে বলি ” placebo effect “।
১১। কিন্তু রোগের মূল যে কারন তার অবচেতন মনের চাপ,দ্বন্দ্ব সেটির নিরসন না হওয়ার কারনে এবং মানসিক সক্ষমতা না বাড়ানোর কারনে, যখনি পরীক্ষা বা কোন চাপের মুখে পড়ে তখনি তার পূর্বের সমস্যা আবার দেখা দেয়।
১২। তাই জ্বীন- ভূত তাড়ানো নয়,তাদের দরকার মনোরোগ বিশেষজ্ঞের চিকিৎসা
লিখেছেন- প্রফেসর তাজুল ইসলাম