আগে প্রচুর ফেসবুকিং করতাম। ইদানীং কমিয়ে দিয়েছি। সেটা অন্য কারও ওপর রাগ করে নয়, নিজের ওপর বিরক্ত হয়ে। বিরক্তির কারণ হলো, আমি লক্ষ করলাম যে সামাজিক মাধ্যমে এসে আমার ভেতর নানা ধরনের অসামাজিক চিন্তাভাবনার জন্ম হচ্ছে। তার মধ্যে একটা হলো অন্যের সুখ দেখে হিংসা করা। দেখলাম নিউজ ফিডে কেউ যদি নিজের ব্যাপারে ভালো কিছু বলে বা নিজের জীবন নিয়ে ভালো কিছু শেয়ার করে, তাহলে তাদের জন্য খুশি না হয়ে আমার তাদের প্রতি হিংসা হচ্ছে। নিজের ব্যাপারে এটা ভালো লাগল না। ভাবলাম থাক, তাহলে আমি কয়েক দিন সামাজিক মাধ্যমে চলাফেরা কমিয়ে দিই।
দেশ থেকে শুরু করে বিদেশে থাকা আত্মীয়স্বজন আর বন্ধুবান্ধবের খবর আমরা পাই ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম বা টুইটার থেকে। কী খেলাম, কেমন আছি, কী পরব অথবা পড়ব, কোথায় যাচ্ছি, কোথায় যেতে ইচ্ছা করছে—সব জানাই ফেসবুকের মাধ্যমে। কেনাকাটা করি ফেসবুকে, সামাজিক দায়িত্ব পালন করি ফেসবুকে, এমনকি রক্তের প্রয়োজনে আশ্রয় নিই সামাজিক মাধ্যমের। ক্রমেই আমাদের একটা বড় জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক মাধ্যম আর শুধু বিনোদনের জায়গা নেই। সামাজিক মাধ্যম এবং বিশেষ করে, ফেসবুক অনেকের জন্যই একধরনের সমান্তরাল জগতে পরিণত হয়েছে।
এখন ফেসবুক বা সামাজিক মাধ্যমে আচরণ এবং অনুভূতির সঙ্গে দৈনন্দিন জীবনের আচরণ ও অনুভূতি আলাদা করে দেখার কোনো যৌক্তিকতা আমি দেখি না। সাধারণ জীবনে যদি ঈর্ষাবোধ বেড়ে যায়, তাহলে আমরা স্বভাবতই চিন্তিত হয়ে পড়ব। চেষ্টা করব কীভাবে নিজের ভেতর থেকে এ ধরনের নেতিবাচক চিন্তাভাবনা দূর করা যায়। তাহলে ফেসবুক ভিন্ন হবে কেন?
আমি চিন্তা করে দেখলাম, যেকোনো দাওয়াত বা যেকোনো জায়গায় গিয়ে যদি আমার আশপাশের মানুষের সুখ সহ্য না হয়, তাহলে আমি কী করব। প্রথমে হয়তো সেসব জায়গায় যাওয়া কয়েক দিনের জন্য বন্ধ রাখব। এ জন্যই আপাতত আমার ফেসবুকে যাওয়া-আসা কম। তবে এটা কোনো ধরনের স্থায়ী সমাধান নয়। কেন আমার ভেতরে নেতিবাচক চিন্তা বা অনুভূতি হচ্ছে, সেটা বুঝতে হবে এবং সেই চিন্তা বা অনুভূতিগুলো ঝেড়ে ফেলতে হবে।
অন্যদের সুখে কেন খুশি হতে পারছি না? অনেক চিন্তা করে দেখলাম, এর কারণ হয়তো-বা আমি আমার নিজের জীবন নিয়েই অসন্তুষ্ট। এই অসন্তুষ্টির সমাধান কী? সমাধান অনেক স্তরের। প্রথমত, চিন্তা কম করে যেসব কাজ করে মন আর শরীর ভালো লাগে, সেগুলো করা। আমার জন্য এ ধরনের কাজ মানে দৌড়ানো, অর্থাৎ ব্যায়াম করা আর ছবি তোলা। দৌড়ানো শুরু করলাম নতুন উদ্যমে। সিদ্ধান্ত নিলাম, যা-ই হোক না কেন সপ্তাহে অন্তত দুই দিন আমি ছবি তুলব।
আরেকটা জিনিস, যেটা করলে আমার মন আর শরীর হালকা হয়, সেটা হলো ঘুরে বেড়ানো। ব্যস্ত জীবন আমার। সব সময় বড় ছুটি নেওয়ার সুযোগ হয় না। তাই বলে হাত-পা গুটিয়ে রাগ আর হিংসা পুষে রাখা ঠিক হবে না। ঠিক করলাম আর কোথাও না যেতে পারলে চিড়িয়াখানায় যাব। নিজের মতো আরও কয়েকটা বানর দেখব। ছবি তোলা, দৌড়ানো, ঘর থেকে বেরিয়ে একটু ঘোরাঘুরি করা খুব জটিল কোনো কাজ নয়। কিন্তু অদ্ভুতভাবে লক্ষ করলাম, এই সহজ জিনিসগুলো কাজে দিচ্ছে। মন ভালো লাগছে। অন্যদের সুখও আমাকে আনন্দ দিচ্ছে। তবে এখানেই শেষ নয়।
ভেবে বের করলাম যে অসন্তুষ্টির আরেকটা কারণ হলো, নিজের যা আছে সেটার ব্যাপারে আমি যথেষ্ট কৃতজ্ঞ নই। অনেক সময় আমরা আমাদের জীবনের খারাপ দিকগুলো নিয়ে বেশি মনোযোগী হয়ে পড়ি। তখন নিজের জীবন দুর্বিষহ মনে হয়। অন্যদের সুখ দেখলে বিরক্ত লাগে। এই ফাঁদ থেকে মুক্তি পাওয়ার একটা সহজ উপায়, প্রতিদিন অনুশীলনে নিজের জীবনে ভালো জিনিসগুলো নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবা এবং ভালোর জন্য কৃতজ্ঞ হওয়া। তখন নিজের অস্তিত্বের প্রতি মমতা বাড়ে। অন্যদের সুখের প্রতি সহানুভূতি আসে।
সামান্য ফেসবুকে প্রতিহিংসাপরায়ণ হওয়া নিয়ে এত চিন্তা কেন? কারণ আগে যেটা বললাম। ফেসবুকের অনুভূতি আর সাধারণ জীবনের অনুভূতি পৃথক করার কিছু নেই। নেতিবাচক চিন্তা যেখানেই আসুক, দূর করতে হবে। এবং দূর করা সম্ভব।
লেখক: অভিনেতা
অন্যের সুখে অসুখী!
Facebook Comments