অপরাজিতা
অধ্যাপিকা চেমন আরা সুসাহিত্যিক, ভাষা সৈনিক, শিক্ষাবিদ সমাজসেবক, সুগৃহিণী, আদর্শ মা,নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় আপোষহীণ পাঞ্জেরী। এ সমস্ত বিশেষণই তাকে বিশেষায়িত করা যায়। তিনি ৪৭ এর ভারত বিভাগ দেখেছেন, ৫২ ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। ‘৭০ এর নির্বাচন আর ৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধ এ সমস্ত ঘটনার দীপ্যমান স্বাক্ষী হয়ে রয়েছেন।
জন্ম পরিচয়: অধ্যাপিকা চেমন আরা ১৯৩৫ সালে চট্টগ্রামের এক সম্ভ্রান্ত শিক্ষিত এবং ধর্মপ্রাণ পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। চট্টগ্রামে শিক্ষা প্রসারে তাদের পরিবারটি উনিশ শতকে বিরাট ভূমিকা পালন করেছে। তার পূর্ব পুরুষ সুফি, পদস্থ সরকারী কর্মকর্তা ও বহু গ্রন্থের প্রণেতা মওলানা আবুল হাসান। এবং তার পুত্র, পৌত্র, প্রপৌত্র-প্রপৌত্রী বংশ পরস্পরায় ধর্মীয় সামাজিক ও শিক্ষা জগতে অনন্য গৌরবের অধিকারী। তার পিতা এ.এস. এম. মোফাখখার ছিলেন অবিভক্ত ভারতবর্ষের কলকাতা হাইকোর্টের কতিপয় মুসলিম আইনজীবিদের অন্যতম। তিনি রাজনৈতিক ও সমাজকর্মী ছিলেন। পিতামাতার পাঁচ পুত্র ও চার কন্যার মাঝে অধ্যাপিকা চেমন আরা তৃতীয়। মা দোরদানা খাতুন ও দাদী আছফা খাতুনের স্নেহ আর তত্ত্বাবধানেই ধর্মীয় পরিবেশ ও শিক্ষিত পারিবারিক ঐতিহ্যে তার শৈশব অতিবাহিত হয়েছে।
অপরাজিতা: আপনার শৈশবের দিনগুলো কি এখনও আপনাকে নাড়া দিয়ে যায়? কেমন কেটেছে আপনার শৈশব?
চেমন আরা: অবশ্যই! এক কথায় বলা যায় আমি তো রাজকীয়ভাবে আমার শৈশবকে উপভোগ করেছি। আমাদের ছেলেবেলা ধর্মীয় পরিবেশে লেখাপড়ার পরিবেশে, সাংস্কৃতিক পরিম-লে কেটেছে। ধর্মীয় গোড়ামী বা কুসংস্কার ছিলো না। আমরা প্রতিদিন ভোরে উঠে নামাজ পড়ে আমপড়া পড়তে বসতাম। এরপর গোসল করতে পুকুরে যেতাম। সেখানে ছেলে মেয়েদের আলাদা ঘাট ছিলো। দুপুরে খাওয়া দাওয়া শেষে আমরা একটু ঘুমিয়ে নিতাম। তারপর বিকালের অবসরে বাড়ির আঙ্গিনায় মা, দাদীর সাথে সবজি বাগানের পরিচর্যা করতাম। তখন একটা বিষয় এমন ছিলো যে, আমরা ছোটরা সবসময় বড়দের সম্মান করতাম। তাদের অবধি হব এটাই ভাবাই যেতো না।
অপরাজিতা: তখনকার সামাজিক প্রেক্ষাপট আর আজকের প্রেক্ষাপটকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ণ করবেন?
চেমন আরা : সেকালের আর একালের সামাজিক প্রেক্ষাপটের মধ্যে অনেক বেশি পার্থক্য আছে বলে আমি মনে করি। আমার সময়টায় ভাতৃত্ববোধ, পারস্পরিক সহমর্মিতা, সহযোগিতা, পাড়া-পড়শীর অভিভাবক সূলভ ব্যবহার ইত্যাদি সব ছিলো। আর এখন আমরা পাশের ফ্ল্যাটে কে আছে তাই জানি না। সামান্য স্বার্থের কারণে হত্যা, খুন, অনৈতিকতা ইত্যাদির যেন সঅয়লাব শুরু হয়ে গেছে। আমাদের সময় ছোটদের প্রতি স্নেহ, আদর, শাসন যেমন ছিলো তেমন আমরা যারা ছোট ছিলাম তারা বড়দেরকে তাদের সমান আর মর্যাদার আসনে বসিয়ে রাখতাম। এক কথায় বলা যায় এখন যেমন ঐশী তৈরি হচ্ছে তশ ঐশী তৈরির হওয়ার মতো কোন পরিবেশেই ছিলো না। শান্তি,স্থিতি আর নিরাপত্তা ছিলো। ভিন্ন মতাবলম্বীদের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা ছিলো।
অপরাজিতা: ‘চল্লিশের দশকে নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে হিন্দু মেয়েরা ছিলো এগিয়ে আর মুসলিম মেয়েরা পিছিয়ে’ এ বিষয়টি আপনি কেমন দেখছেন?
চমেন আরা : আমি ম্রেট্রিক পাশ কোন দেখি নাই। হ্যা বিষয়টি এমনই ছিলো। হিন্দু মেয়েরা দল বেঁধে স্কুলে যেত। মুসলিম মেয়েরা শুধু চিঠি পড়ে আর আরবী কোরআন শরীফ পড়া এতটুকুই শিখতো। ওরা বাহে নামা নামক একটি বই পড়তো কিন্তু আমাদের পরিবারে মেয়েদের শিক্ষিত হওয়া উচিত এই দৃষ্টিভঙ্গিই ছিলো। আমায় বাবা সবসময় বলতেন তোমরা কি করছো। পড়ালেখা শিখছো না কেন?
হিন্দু মেয়েরা বড় এগিয়ে যাচ্ছে। তোমাদেরকেও এগিয়ে যেতে হবে। তবে তখন মুসলিম মেয়েদেরকেও যে লেখাপড়া শিখে এগিয়ে যেতে হবে এ উপলব্ধিটা সবার মধ্যে সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিলো।
চেমন আরার শিক্ষাজীবন : অধ্যাপিকা চেমন আরার প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি মা দোরদানা খাতুন ও দাদি আছফা খাতুনের কাছে। তিনি ১৯৪১ সালে চট্টগ্রাম শহরের গুল-এজার বেগম স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৫১ সালে ঐতিহ্যবাহী কামরুন্নেসা উচ্চ ইংরেজি বালিকা বিদ্যালয় থেকে মেট্রিকুলেশন পাশ করেন। ১৯৫৩ সালে ইডেন কলেজ থেকে আই.এ পাশ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে অনার্স ভর্তি হন। ১৯৫৬ সালে বি.এ অনার্স এবং পরের বছর এম. এ পাশ করেন।
অধ্যাপিকা চেমন আরা যখন ইডেনে আই.এ পড়ছিলেন তখনই সক্রিয়ভাবে ভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন।
অপরাজিতা: ভাষা আন্দোলনে আপনার অংশগ্রহণটা কিভাবে হয়েছিলো।
চেমন আরা : আমি তখন সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী। প্রিন্সিপাল আবুল কাশেমসহ তমুদ্দন মজলিশের অন্যান্য কর্মীর সাথে পরিচিত হই এবং এ সংগঠনের কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ি। মূলতঃ আমার বাবার সুবাদেই । কারণ ১৯৪৭ সালের পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর তৎকালিন সরকার সংখ্যারিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা বাংলাকে অগ্রাহ্য করে উর্দূকে রাষ্ট্র ভাষা করার প্রচেষ্টা চালালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুন অধ্যাপক আবুল কাশেম সমমনা তরুন যুবকদের সংগঠিত তরে ১৯৪৭ সালের ১লা সেপ্টেম্বর প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন তমদ্দুন মজলিশ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৫ সেপ্টেম্বর তমদ্দুন মজলিশের পক্ষ থেকে ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দূ না বাংলা’ শীর্ষক ১৮ পৃষ্ঠার একটি পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়। ১৯৪৮ সালের ১৪ নভেম্বর প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম প্রকাশ করেন ভাষা আন্দোলনের মুখপাত্র ‘সাপ্তাহিক সৈনিক’। তিনি চট্টগ্রামের অধিবাসী হওয়ায় বিভিন্ন পরামর্শের জন্য আমার আব্বার কাছে যেতেন। সে থেকেই তার আন্দোলনের সম্পৃক্ত হওয়া। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করায় দাবীতে তমদ্দুন মজলিশের বিভিন্ন সভা-সমাবেশ সেমিনার, সাহিত্য সভায় যোগদান করা, বাংলা ভাষার জন্য পোস্টার লেখা সেগুলো স্কুল কলেজের দেওয়ালে লাগানো, প্রচার পত্র বিলি করা ইত্যাদি আমরা স্কুলে থাকা অবস্থায় করেছি। তারপর যখন ইডেনে ভর্তি হলাম অর্থাৎ ৫১-৫২ সালের সেই উত্তাল দিনগুলোতে সক্রিয় কর্মী হিসাবে কাজ বাকি। বিশেষ করে একুশ ফেব্রুয়ারী পুলিশের গুলিতে শহীদ আবুল বরকতের রক্তমাখা শার্ট নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা যে মিছিল বের করেন অন্যান্য ছাত্রীদের সাথে আমিও যে মিছিলে ছিলাম। একুশে ফেব্রুয়ারী আমতলায় ছাত্রসভা শেষে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে যে মিছিল হয় সেই মিছিলেও আমি অন্যান্যদের সাথে ছিলাম।
অপরাজিতা: ভাষা আন্দোলনের প্রাপ্তি কতটা হয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
চেমন আরা : ভাষা আন্দোলনেরে পথ ধরেই তো স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং আজকের বাংলাদেশ। তবে ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে আমরা যে তমদ্দুন সংস্কৃতির প্রসার চেয়েছিলাম তা অর্জিত হয়নি। মাঝে মাঝে দেশের সংস্কৃতি, মানুষের ভাব বোধের অবস্থা দেখে অপসংস্কৃতির সয়লাব হিন্দি সিরিয়ালের প্রভাব আমাদের নতুন প্রজন্মের মধ্যে হিন্দি প্রীতি দেখে সত্যিই খুব কষ্ট হয়। তখন মনে হয়, আমরাতো আমাদের ঐতিহ্য সংস্কতিকে হারাতে চাইনি বলেইতো ভাষা আন্দোলন করেছিলাম। আমরা কি আমাদের নতুন প্রজন্মকে এ কথা বুঝাতে ব্যার্থ হলাম।
কর্মজীবন : অধ্যাপিকা চেমন আরা শুধু একজন ভাষা সৈনিকই ছিলেন না। দীর্ঘ ৩৬ বছরের কর্মজীবনে তিনি হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে শিক্ষার আলো বিস্তার করে গেছেন। তিনি ১৯৫৯ সালে নারায়নগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ গার্লস হাই স্কুলে প্রধান শিক্ষিকা হিসাবে যোগ দেন। সে বছরই বাদশা মিয়া চৌধুরী প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রামে প্রথম মহিলা কলেজে বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করেন। ১৯৫৯-৬১ সালে চেমন আরা আন্দরকিল্লাস্থ মুসলিম এডুকেশন সোসাইটির স্কুলে প্রাতঃকালীন শিফ্টে সহকারী প্রধান শিক্ষিকা হিসাবে কাজ করেন। ১৯৬২ সালের মাঝামাঝি সময়ে ইডেন কলেজে আসেন। পরে সহকারী অধ্যাপক পদে ১৯৬৭-৬৮ আবার চট্টগ্রামে সরকারী কলেজে বাংলা বিভাগে যোগদান করেন। ১৯৭০ সালে আবার ইডেন এ আসেন এবং অধ্যাপনার পাশাপাশি নতুন হোস্টেলের তত্ত্বাবধায়ক হিসাবেও কাজ করেন। এ দায়িত্ব পালন করেন দীর্ঘ ১২ বছর অর্থাৎ ৮২ সাল পর্যন্ত। তিনি ৮২-৮৬ পর্যন্ত চট্টগ্রাম সরকারী মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন এবং ১৯৯৩ সালে তীতুমীর কলেজ ঢাকা থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
অপরাজিতা: ইডেন কলেজে আপনার যে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়েছে সে বিশেষ করে হোস্টেল সুপারেন্টন হিসাবে আপনার দায়িত্ব পালন সম্পর্কে জানতে চাই।
চেমন আরা : আমি ইডেনে নতুন হোস্টেলের সুপার ছিলাম। চেষ্টা করেছি ছাত্রীদের ভালো রাখতে। ওদেরকে নানা রকম সামাজিক কর্মকা-ে অংশগ্রহণ করাতে। হোস্টেলে মেয়েদেরকে নিয়ে সাপ্তাহিক ইসলামী আলোচনা হতো। এছাড়াও আমি যখন চট্টগ্রামে ছিলাম সেখানেও মহিলা কলেজে ‘ইসলামী পাঠচক্র’ চালু করেছিলাম। সেই পাঠচক্রে মুসলিম মহিয়সীদের কর্মজীবনের উপর ধারাবাহিক আলোচনা হতো।
ইডেনে হোস্টেল যে ইসলামী আলোচনা অনুষ্ঠান হতো ‘মহিলা মজলিস’ এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করতো। আমি চেষ্টা করেছি তাদেরকে সার্বিক সাহায্য সহযোগিতা করার।
অপরাজিতা: আপনার সাহিত্য হাতেখড়ি কবে থেকে? এক্ষেত্রে আপনার পথ চলাÑ
চেমন আরা : মূলতঃ আমার পিতা-পিতামহ ও স্বামী উভয়দিক থেকেই আমি সাহিত্যে উত্তরাধিকার লাভ করেছিলাম বলা যায়। যখন আমি অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী তখন ‘সাপ্তাহিক সৈনিকে’ আমার প্রথম গল্প ছাপা হয়। এরপর থেকে সাপ্তাহিক সৈনিকে নিয়মিত লেখা শুরু করি। চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল খালেক সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘কহিনূর’ পত্রিকায় ‘নাসরিন’ ছদ্মনামে লিখতাম। এছাড়াও কলিকাতা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক কাফেলা পত্রিকায় এবং বিভিন্ন দৈনিকে নিয়মিত লেখতে থাকি। সে থেকেই এ অঙ্গনে পথ চলা। এ পর্যন্ত আমার প্রকাশিত বইগুলো হলো।
১. হৃদয় নামের সরোবর
২. ঘরে ফেরা
৩. হজ্জ ও ওমরার স্মৃতি
৪. কান্না হাসির এই মেলায়
৫. স্বাগত ভাবনা
৬. নিরুদ্দেশের অভিযাত্রী
৭. সত্তরের সিড়িতে দাড়িয়ে।
এছাড়াও সম্পাদন করেছি এ ‘অনন্য জীবন সঠিক (এ.এস.এম মোফাখখার) ইয়াদগারে বখতিয়ার। সহজ মিলাদ পাঠ শাহেদ আলী ৫টি স্মারক গ্রন্থ।
এখনও অপ্রকাশিত গল্প ও কবিতার বইয়ের সংখ্যা প্রায় ৪টি। মূলত গল্প, কবিতা, ভ্রমণ কাহিনী, স্মৃতি কথাই আমার লেখার মূল বিষয়বস্তু।
অপরাজিতা: পারিবারিক জীবনের চড়াই উৎড়াই পেরিয়ে সন্তান, সাহিত্য আর কর্মজীবন সব কিছুর সমন্বয় কিভাবে করছেন?
চেমন আরা : ১৯৫০ সালে তখন আমি দশম শ্রেণির ছাত্রী, সেই সময় সাপ্তাহিক সৈনিকে প্রকাশিত আমার লেখা পছন্দ করে আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন শাহেদ আলী এবং বিয়েও হয়ে যায়। ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক বিশিষ্ট সাহিত্যিক শাহেদ আলী সাহেবের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সাহিত্যাঙ্গনে আমার পথ চলা আরো সংহত হয়েছে এবং ভাষা আন্দোলনের সাথে আমার সম্পৃক্ততা বহুগুণে বৃদ্ধি পায় এবং এ আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী হিসাবে আমি নিজেকে তৈরি করে নেই। তার সাথে ৪১ বছরের আমায় বিবাহিত জীবনের নানান সমস্যা ঘাত-প্রতিঘাত দুজনে মিলেই সামলিয়েছি। আমার তিন ছেলে তিন মেয়ে। আলহামদুলিল্লাহ ছেলে মেয়েরা সবাই উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত এবং স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত।
স্বীকৃত ও সম্মননা : অধ্যাপিকা চেমন আরা ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ ও অবদান, শিক্ষকতা, সাহিত্য, সেবা, সামাজিক সাংস্কৃতিক চর্চা এবং অবহেলিত নারী ও শিশুদের জীবন মান উন্নয়নে অবদানের জন্য
১. ২০০৪ সালে মহিলা সাংবাদিক ফোরাম
২. ২০০৪ সালে ফুলের মেলা জাতীয় শিশু সংগঠন পুরস্কার
৩. ২০০৬ সালে কিশোর কণ্ঠ সাহিত্য পুরস্কার
৪. ২০০৭ সালে চিল্ড্রেন অ্যান্ড উইমেন ভিশন ফাউন্ডেশন স্বর্ণপদক।
৫. ২০০৮ সালে নবীন কর্ণ সাহিত্য সাংস্কৃতিক পুরস্কার
৬. ২০০৮ সালে জালালাবাদ ফাউন্ডেশন কর্তৃক হাসান রাজা পুরস্কার সম্মাননা।
৭. ২০০৯ সালে মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী স্বর্ণপদক
৮. ২০১১ সালে ভাষা আন্দোলনে অসামান্য অবদানের জন্য চট্রগ্রামের কৃতি সন্তান হিসাবে চট্টগ্রামে সমিতি থেকে সম্মাননা।
৯. ২০০৯ সালে রুরাল জার্নালিস্ট ফোরাম পুরস্কার
১০. ২০১২ সাপ্তাহিক সমধারা থেকে ভাষা সৈনিক সম্মাননা।
১১. ২০১২ সালে ফুলকুঁড়ি ও ঝিঁঙ্গেফুল শাখা শ্রেষ্ঠ মা সম্মাননা।
১২. চিলড্রেন অ্যান্ড ওমেন ভিশন থেকে বিজয় দিবস সম্মাননা।
অপরাজিতা : আজকের বাংলাদেশ মুসলিম ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতি ইত্যাদি সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কি?
চেমন আরা : আজকের বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মুসলিম ঐতিহ্য সংস্কৃতি অবহেলায়, অযতেœ রয়েছে। আমরা যে ঐতিহ্যে বড় হয়েছি, নতুন প্রজন্মের কাছে তা একেবারেই অচেনা। রাষ্ট্রীয়ভাবে এর কোন পৃষ্টপোষকতা করা হচ্ছে না বরং নতুন নতুন উৎসব যেগুলোর সাথে আমাদের সংস্কৃতি ভাববোধের কোন সম্পর্ক নেই তার প্রসার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ইদানিং শোনা যাচ্ছে ‘ধর্ম যার উৎসব সবার’ এটা তো ইসলামী সংস্কৃতি এবং তাওহীদের বিশ্বাসের পরিপন্থী। থার্টি ফাস্ট নাইট, ভালোবাসা দিবস, পহেলা বৈশাখের নামে যে সমস্ত আচার-অনুষ্ঠান উদযাপিত হচ্ছে এতে করে ইসলামের সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমি বলব পরিকল্পিতভাবে ইসলামকে নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে। হিন্দী সিরিয়াল, মুভি, এপার বাংলা ওপার বাংলার সংস্কৃতির আদান প্রাদন ইত্যাদি সমস্ত কিছুই তাওহীদের পরিপন্থী। অথচ আমাদের মুসলমানদের মূলভিত্তিই তাওহীদের উপর প্রতিষ্ঠিত। ইদানিং বিজ্ঞাপনগুলো মিউজিক শোগুলো যেভাবে আমাদের তরুনদেরকে ভুল ম্যাসেজ দিচ্ছে তাতে করে আমি সন্দিহান। এরা বড় হয়ে ইসলামকে কেমনভাবে জানাবে। এ অবস্থা থেকে তো এদেরকে বের করে আনতে হবে।
সমাজকর্ম : অধ্যাপিকা চেমন আরা সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে যে সমস্ত কাজ করেছেন যেগুলো হলো।
১. ১৯৫৪ সালে ডানপন্থী ছাত্রীদের সমন্বয়ে ফরমান উল্লাহ খানের তত্বাবধানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ছাত্রী পরিষদ’ গঠন করেন। এখানে তিনি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।
২. ১৯৬৩ সালে শিশু কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক উৎকর্ষ সাধন এবং এদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে ‘সবুজ সেনা’ গঠন করেন এবং ১৯৭০ সাল পর্যন্ত এ সংগঠনের দায়িত্ব পালন করেন।
৩. চট্টগ্রাম মহিলা কলেজে ‘ইসলামী পাঠচক্র‘ নামে মহিলাদের জন্য একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠ করেন। এখানে ইসলামী দর্শণ, মানবতাবোধ, হযরত খাদিজা (রাঃ), হযরত ফাতেমা (রাঃ)সহ মুসলিম মহিলাদের কর্মজীবন ধারাবাহিভাবে আলোচনা হতো।
৪. তিনি অবসরে যাবার পর ইসলাম প্রিয় মহিলাদের নিয়ে ‘নারী’ অধিকার আন্দোলন সনামে একটি সংগঠন গঠিত হলে তিনি যেখানে সভানেত্রী নির্বাচিত হন। সূচনালগ্ন থেকে তিনি এ সংগঠনের চেয়ারপার্সন।
৫. ১৯৮৭ সালে কথাশিল্পী শাহেদ আলী, ড. কাজী দীন মুহাম্মদ. ড. শমশের আলী, জাতীয় অধ্যাপক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ এবং অনেক প্রাজ্ঞজনের আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টায় একটি স্কুল ‘তামরিন’ প্রতিষ্ঠিত হলে চেমন আরা এই স্কুলের পরিচালনার ভার নেন।
অপরাজিতা: জীবনের এই শেষ বেলায় এসেও আপনি জাতিগঠনের কাছে নিয়োজিত রয়েছেন কোন উপলব্ধি থেকে?
চেমন আরা : আমি মনে করি সমাজের প্রতি আমার একটা দায়বদ্ধতা আছে। আমি যতটুকু জানি, উপলব্ধি করি তা যেন সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারি। আমার দ্বারা যদি একজনও উপকৃত হন তাহলেই আমি স্বার্থক । আলহামদুলিল্লাহ কলেজে অধ্যাপনা কালীন সময়ে আল্লাহ আমাকে এ সূযোগ করে দিয়েছেন আমি হাজার হাজার ছাত্রীদের মাঝে আমার আদর্শ, মূল্যবোধ ছড়িয়ে দেবার চেষ্টা করছি। যখনই যে ধরনের কাজের সূযোগ পেয়েছি আমি আন্তরিকতার সাথে তা করার চেষ্টা করেছি। আমি সবসময়ই চাই ইসলামী সংস্কৃতি ও মুসলিম ঐতিহ্য রক্ষায় আজীবন কাজ করে যাব। আপনারা দোয়া করবেন আল্লাহ যেন আমাকে সেই তৌফিক দেন। আমীন॥