banner

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 523 বার পঠিত

 

বহে সমান্তরাল

ফাতিমা মারিয়ম


আম্মু, আমার না আব্বু আর তোমার সাথে কোথাও বেড়াতে যেতে ইচ্ছে করছে। আমরা এখন আর একসাথে থাকিনা কেন?

কেয়া চুপ করে সামিরার কথা শুনে যায়।

জানো, স্কুলে আমার বন্ধুদের কাছে গল্প শুনি তারা ছুটির দিনে বাবা মায়ের সাথে কত্ত জায়গায় বেড়াতে যায়! আমরা আবার কবে একসাথে বেড়াতে যাব?

কেয়া একটু হেসে মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। মেয়েকে কেয়া কিভাবে বোঝাবে সামিরা যা আশা করছে তা আর কখনো সম্ভব নয়। একসাথে তাদের আর কখনোই বেড়ানো হবেনা।

শুধুমাত্র মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কী কষ্টই না সে ভোগ করেছে। প্রায় দুইটা বছর অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করেছে। প্রথম দিকে নির্যাতন ছিল শুধু মানসিক। পরে গায়ে হাত তোলা পর্যন্ত গড়ায়। আর অবজ্ঞা অবহেলা তো ছিলই।

একটা মানুষ আর কত সহ্য করতে পারে? মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে, পরিবারের মান সম্মানের কথা ভেবে জাকিরকে বহু বোঝানোর চেষ্টা করেছে। ফেরানোর চেষ্টা করেছে।

পরিবারের পছন্দেই জাকিরকে বিয়ে করেছিল সামিরা। শুরুতে জাকির এমন ছিল না। আর দশটা পরিবারের মতই বেশ সুখ আর আনন্দে জাকির কেয়ার দিন কেটে যাচ্ছিল। কখনো বড় ধরনের কোন ঝামেলা হয় নি। বিয়ের প্রায় দুই বছর পর সামিরার জন্ম হয়। তিনজনের সংসারটা যেন আক্ষরিক অর্থেই ‘সুখের সংসার’ ছিল।

কিন্তু কীভাবে যে কি হয়ে গেল! কেয়া আজো তার হিসেব মেলাতে পারে না।

প্রায় তিন বছর আগের কথা। সামিরার বয়স তখন তিন বছর। কেয়া খেয়াল করে জাকিরের আচরণে কিছু পরিবর্তন হচ্ছে। সময়ের অনেক পরে বাসায় ফেরে। কারণ জানতে চাইলে দুর্ব্যবহার করে। প্রায়ই ছুটির দিনে সকালবেলা বাইরে চলে যায়। ফেরে সেই অনেক রাতে। বাসায় যতক্ষণ থাকে মোবাইল ফোনে কার সাথে যেন কথা বলেই যায়। কেয়াকে দেখলেই আচমকা কথা থামিয়ে দেয়।

ধীরে ধীরে কেয়ার মনে সন্দেহ দানা বাঁধতে থাকে। পরে সে সুযোগ মত কল লিস্ট চেক করতে গিয়ে সুমির নাম্বার পায়। কেয়া জাকিরের কাছে সুমির পরিচয় জানতে চায়। কিন্তু জাকির তাকে উল্টাপাল্টা বুঝিয়ে দেয়। জাকিরের বিভিন্ন আচরণে কেয়ার মনে সন্দেহ আরও বাড়তে থাকে।

একদিন সে সুমিকে ফোন করে। তখন সুমি অকপটে তার কাছে সব কথা স্বীকার করে। সুমি একটি এনজিওতে চাকুরী করে। আজ প্রায় এক বছর ধরে তাদের পরিচয়। অবসর সময়ে দুজনে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। কেয়া চোখে অন্ধকার দেখতে লাগল। সে কিভাবে এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবে?

জাকিরকে সে খুব বোঝাতে থাকে এই পথ থেকে ফিরে আসার জন্য। সে মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়েও জাকিরের কাছে আশঙ্কা প্রকাশ করে।

কিছুদিন পরে কেয়া জানতে পারে সুমির সাথে জাকিরের আর কোন যোগাযোগ নেই। সে এতে বেশ খুশিই হয়। কিন্তু এই খুশি বেশিদিন স্থায়ী হয় না। জাকির আবার আরেকজনের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। তারপর আবার এই সম্পর্ক শেষ হয়। আবার আরেকজন……।

সুমি থেকে শুরু করে প্রতিটা মেয়ের সাথে তার সম্পর্ক অনেকদূর পর্যন্ত গড়ায়। প্রায়ই সে কাউকে না কাউকে নিয়ে অফিসের ট্যুরের কথা বলে কয়েকদিনের জন্য ঢাকার বাইরে চলে যায়।
এবার কেয়ার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। সে সামিরাকে নিয়ে মায়ের বাসায় চলে আসে। মা বাবাকে সব কিছু খুলে বলে। উনারাই কেয়াকে বলেন তোর আর ফিরে যেতে হবেনা। তবুও কেয়া আশায় আশায় ছিল জাকির হয়ত অনুতপ্ত হয়ে তাকে নিতে আসবে! কিন্তু নিতে আসা তো দূরের কথা। একটু যোগাযোগও করেনা। মেয়ের প্রতিও তার বিন্দুমাত্র আকর্ষণ নেই! গতমাসে কেয়ার পক্ষ থেকেই ডিভোর্সের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে।

কেয়া একটি স্কুলে চাকুরী নিয়েছে। মেয়েকে নিয়ে বাবা মায়ের সাথে দিন কেটে যায়……
কেটে যাচ্ছে।

[এভাবে আমাদের সমাজে অনেক কেয়া জীবন যাপন করছে। এক বা একাধিক বাচ্চার দায়িত্ব মাকেই বহন করে তিল তিল করে বাচ্চাদের মানুষ করে তোলে। নিম্নবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত সব সমাজেই কেয়া বা সামিরা আছে। এছাড়াও আরও অনেক ধরনের বঞ্চনার শিকার হয়ে যেসব নারী দিনাতিপাত করছে তাদের নিয়েই আমার নতুন সিরিজ ‘ঝিনুক নীরবে সহে’।]

Facebook Comments