banner

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 1247 বার পঠিত

 

বইয়ের সাথে সখ্যতা

বৈশালী রহমান


বাংলা সাহিত্যের একটা শাখা নিয়ে আমার একটু ক্ষোভের মতো আছে। সেটা হলো, ভৌতিক গল্প।

গত এক বছর ধরেই ফেসবুকিং কমিয়ে পড়াশোনা করছি প্রচুর। শুধু রিসার্চের পড়াশোনাই নয়, বাংলা সাহিত্য, গল্প, উপন্যাস, নন ফিকশন ইত্যাদিও ঝালাই করে নিচ্ছি খানিকটা।

সাহিত্যের অন্য শাখাগুলো যেমন রোমান্টিক, রহস্য, রম্য, ট্র্যাজেডি ইত্যাদিকে বাংলা সাহিত্য এবং সাহিত্যিকেরা আপন করে নিলেও এই হরর বা ভৌতিক শাখাটা কেন যেন অবহেলিতই রয়ে গিয়েছে। অধিকাংশ সাহিত্যিকরাই ভূতের গল্প লিখতে গিয়ে সেটাকে করে ফেলেছেন একেবারে ছেলেমানুষি বিষয়, হাস্যকর বস্তু, যেমনটা দেখা যায় প্রখ্যাত সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের “অদ্ভুতুড়ে সিরিজ” এ, নয়তো বিদেশী পিশাচ বা জম্বি কাহিনির অক্ষম অনুকরণ, যেটা করেছেন রহস্য পত্রিকা বা সেবা প্রকাশনী কেন্দ্রিক লেখকেরা।

বাংলার প্রকৃতি, পরিবেশকে আপন করে নিয়ে তার ভিত্তিতে গা ছমছমে ভূতের গল্প লিখতে দেখেছি খুব কম লেখককেই। তবে ভূতের গল্পে চমৎকার মানবিক প্রলেপ নিয়ে এসেছেন তারাশঙ্কর, মনোজ বসু বা পরশুরাম।

পরশুরামের বিখ্যাত গল্প “ভূষণ্ডীর মাঠে” তে ধর্মীয় কিছু সংস্কার নিয়ে ভূতের সংলাপের মাধ্যমে চমৎকার স্যাটায়ার রয়েছে। আবার “মহেশের মহাযাত্রা” পরশুরাম সুলভ স্যাটায়ার দিয়ে শুরু হলেও শেষ দিকে বেশ গা ছমছম করেই ওঠে। হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় নামে এক স্বল্প পরিচিত লেখকও চমৎকার কিছু ভূতের গল্প লিখেছেন। শরদিন্দু তাঁর বিখ্যাত চরিত্র বরদাচরণের জবানিতে লিখে গেছেন কয়েকটি অসাধারণ ভৌতিক গল্প।

বাংলায় প্রথম সম্পূর্ণ ভৌতিক উপন্যাস লেখেন ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়, যদিও তাঁর লেখার মধ্যেও “শিশুদের জন্য প্রযোজ্য” ছাপই প্রবল। বড়োরা ওইসব লেখা পড়ে ভয় পাবে, এই সম্ভাবনা কম। মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারও চমৎকার দুটি পিশাচ উপন্যাস এবং কিছু ভৌতিক ছোটো গল্প লিখেছেন। কিন্তু সেইসব লেখার অধিকাংশের মধ্যেও কিছুটা মৌলিকতার অভাব আছে বলে মনে হয়েছিল আমার কাছে। বিদেশী গল্পের ছাপটা বেশ প্রকট। তবে কিছু কিছু গল্প সত্যিই চমৎকার।

আমার মতে, সার্থক ভৌতিক গল্প সেটাই, যেটা দেশ-কাল-পরিস্থিতি-পরিবেশকে তুলে ধরে এমন একটা ভয়ংকর আবহ এর সৃষ্টি করবে, যাতে করে গল্প পড়ার পর পাঠকের একা একা অন্য রুমে যেতেই ভয় লাগবে। যেখানে বাংলায় সার্থক ভূতের গল্পেরই অভাব, সেখানে ভূতের গল্পের একটা অনবদ্য অনুষঙ্গ, তন্ত্র, তান্ত্রিক সন্ন্যাসী প্রভৃতি সহযোগে বেশ “উপাদেয়” ভৌতিক গল্পের অভাব থাকাটা স্বাভাবিক। এই অভাব খানিকটা পূরণ করেছিল প্রখ্যাত সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর হাতে সৃষ্ট এবং পরবর্তীতে তাঁর সুযোগ্য পুত্র তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এর হাতে জীবন্ত রূপ পাওয়া চরিত্র তারানাথ তান্ত্রিকের গল্পগুলো। তারপর হাতে এলো অলাতচক্র। তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এর আরেকটি মাস্টারপিস। এরপর তন্ত্র এবং তান্ত্রিক চরিত্র সম্বলিত ভূতের গল্প পড়ার জন্য মনটা আনচান করছিল। কিছু থার্ড ক্লাস গল্প হাতে এসে মনটাই খারাপ হয়ে গেল।

মনে হচ্ছিল, আমি লিখলেও বোধহয় এর চেয়ে ভালো লিখতে পারতাম। ঠিক এ সময়েই খানিকটা রহস্যজনক ভাবেই ঠিক গতকাল রাত দুটোর সময় হাতে চলে এলো গজেন্দ্রকুমার মিত্র মহাশয়ের “অলৌকিক কাহিনি সমগ্র”।

মিত্রমশাইয়ের নাম যারা মনে করতে পারছেন না, তাঁরাও অনেকেই বোধহয় তাঁর রচিত বিখ্যাত উপন্যাস “পৌষ ফাগুনের পালা”র নাম শুনে থাকবেন। এটি মূলত একটি ট্রিলজি, যার প্রথম দুটি হলো “কলকাতার কাছেই” এবং “উপকণ্ঠে”। এই ভদ্রলোক যে এত অসাধারণ ভূতের গল্প লিখতে পারেন এটা জানা ছিল না। কী অসাধারণ পরিবেশ তৈরি করেন তিনি! অভিজ্ঞতা নিশ্চয় জানেন ভূতের গল্পে ভয় পাওয়ার জন্যে পরিবেশ একটা বিরাট ভূমিকা রাখে। আর মিত্রমশাইয়ের গল্পের আরেকটি অসাধারণ বিষয় হলো প্লট। হাজারবার শোনা বা পড়া ভূতের গল্পের চিরাচরিত প্লটের মতো নয়।

বইটির সব গল্প ভালো লাগেনি। অন্তত দশটি গল্প নিম্নমানের মনে হয়েছে। তবে ছয়শ পৃষ্ঠার একটি সংকলনে এটুকু ছাড় বোধহয় দেওয়াই যেতে পারে।

তারানাথ তান্ত্রিক এবং অলাতচক্র পড়ার পরে যাদের কাছে অন্য সব ভূতের গল্পই পানসে বলে মনে হচ্ছে, তারা এই বইটি পড়ে ফেলতে পারেন। সময়টা বৃথা যাবে না। বিশেষ করে শীতের রাতে কম্বলের তলায় ঢুকে বইটা পড়লে ভয় পাওয়ার গ্যারান্টি ১০০%।

লেখিকা: ডেপুটি ডাইরেক্টর, বাংলাদেশ ব্যাংক।

Facebook Comments