banner

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 527 বার পঠিত

 

নিভে যায় নক্ষত্রের আলো 

ফাতিমা শাহীন


দরজার যন্ত্র পাখিটি ডেকে উঠলো দুবার ৷ রিডিং রুমের কাউচে বসে একটি বইয়ে ডুবেছিলাম মন্ত্রমুগ্ধের মত৷ ডোরবেল শুনে মুখ তুললাম,
থাক,
ঘরে তো লোকজন আরো আছে, খুলে দেবে দরজা কেউ না কেউ৷ আবারও ডুবলাম বইয়ের গহীনে ৷

‘আপা , পাও দুইটা একটু তুইল্লা বসেন , নিচটা ঝাড়ু দিয়া যাই …’

হুকুম মত পা তুলে বসলাম৷ তাকালাম রাহেলার দিকে, থমথমে মুখে রাজ্যের কালো মেঘ ভর করে আছে৷ চোখের কোনায় শুকিয়ে থাকা অশ্রুর দাগও কি চোখে পড়ল আমার!

‘দাঁড়াও রাহেলা!’ কি হয়েছে তোমার? শামসু বুঝি আবারও …..

আমার কথা শেষ হবার আগেই দৌড়ে এসে আমার নামিয়ে বসা পা দুটোর উপর যেন ভেঙ্গে পড়ল রাহেলা৷ একটু সহানুভুতির ছোঁয়া যেন ওর বুকের ভেতর জোর করে চেপে রাখা, ঝরনার মুখ খুলে দিয়েছে কেউ৷ জলপ্রপাতের বাঁধভাঙ্গা জলের মত অশ্রুর প্লাবন বয়ে চলেছে ওর চোখে৷

আস্তে করে শুধালাম ,

‘কি হয়েছে রাহেলা? খুলে তো বলবে আমায়, নইলে বুঝব কেমন করে?’

একটু শান্ত হয়ে আঁচল দিয়ে চোখ মুছে বলল,

‘আমার দুইন্যার দিন মনে হয় শ্যাষ গো আপা! কাইলও জরির বাপে আর ফুফায় ফুফু মিল্যা এমুন মাইর মারলো আমারে! আর কইছে, আমারে আর আমার ভাইরে জন্মের মতন শিক্ষা দিয়া দিব!’

বুঝলাম এতক্ষণে! রাহেলার একমাত্র ননদ-নন্দাই ওর ঘরের আশপাশে ঘর ভাড়া নিয়ে এসে উঠেছে ভাই আর মায়ের কাছাকাছি থাকবে বলে৷ আর এসেই শুরু করেছে ভাইয়ের সংসারের উপর খবরদারি৷ সুখের সংসার বলতে যা বোঝায় তা রাহেলার না থাকলেও এতদিন অন্তত নিজে উপার্জন করে খেত বলে স্বস্তিটা ছিল, এখন যেন সেটুকুর ওপরেও শকুনের নজর পড়েছে ! এখন শ্বাশুড়িও যোগ দিয়েছেন তার আদরের মেয়ের সঙ্গে৷ উদ্দেশ্য একটাই, যদি ফাঁকতালে রাহেলার ভাইয়ের কাছ থেকে নগদে কিছু আদায় করা যায়, তবে মন্দ কি!

ওদিকে রাহেলার ভাইয়ের অবস্থা আরো করুণ৷ নিজে করে লোহা লক্করের কারখানায় শ্রমিকের চাকরি, ওদিকে ঘরে রোগে ভোগা বুড়ো বাপ আর ৩/৪ টা অবুঝ বাচ্চার অনাহারক্লিষ্ট মুখ৷ সে ই বা বোনের শ্বশুরবাড়ির খামতি মেটায় কেমন করে!

রাহেলার কান্না আবার বাস্তবে ফিরিয়ে আনলো আমায়৷

‘ভাইরে কত কইছি, ভাইগো, আমারে এই জাহান্নাম থিকা ছাড়াইয়া লইয়া যাও৷ আমি তোমার ঘাড়ে বইয়া খামুনা, কাম কইরা নিজের ভাত নিজেই জোটামু৷ তাও তুমি আমারে এগো হাত থিকা বাচাও, নাইলে এরা আমারে জানেই মাইরা ফালাইবো৷’

অঝোরে কাঁদতে থাকে রাহেলা, আমারও চোখ দুটো বাষ্পাচ্ছন্ন হয়ে যেতে থাকে ধীরে ধীরে।

প্রায় চার পাঁচ দিন হয়ে গেল


রাহেলার খবর নেই৷ ওকে অনেকবার করে বলা আছে , কোনকারনে আসতে না পারলে আমাকে অন্তত একটা খবর যেন পৌঁছায়৷ কখনো কখনো জরিকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছে বটে, কিন্তু এখনকার মত এভাবে না জানিয়ে এতদিন ডুব দিয়ে কখনো তো থাকেনি রাহেলা!

বাজার এসেছে৷ কর্তা পাঁচমিশালী মাছের চচ্চরি পছন্দ করেন, তাই আজ নিজে বাজারে গিয়ে মনের সুখে কেজিখানেক পাঁচমিশালী গুঁড়া মাছ নিয়ে সহাস্যবদনে হাজির হয়েছেন৷ রাহেলা আসেনি আজ৷ কে কুটবে মাছ, কে বাছবে সবজি! সে চিন্তা তো আর কর্তাকে করতে হয়না! তিনি তো বাজার করে দিয়েই নিশ্চিন্ত আর সময়মত টেবিলেও হাজির!

গজ গজ করতে করতে ডালায় মাছ নিয়ে সবে কুটতে বসেছি, হঠাৎ বাইরে চাপা একটা গোলমাল শুনে কান সজাগ করলাম৷ শুনলাম অনেক নারী পুরুষের সম্মিলিত চাপা আতঙ্কভরা ফিসফাস! উঠে দাঁড়িয়ে জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখি দারোয়ান সিদ্দিক ভাইও ফ্যাকাশে মুখে দাঁড়িয়ে আছে তাদের মধ্যে৷

‘কি হয়েছে সিদ্দিক ভাই? এত মানুষ কেন এখানে? ‘

‘আপা! সর্বনাশ হইছে! আমাগো রাহেলা …..’

আমার হৃদস্পন্দন যেন লহমায় বন্ধ হয়ে এলো৷ কি হয়েছে রাহেলার! দৌড়ে নিচে নামলাম৷ নিচে দাঁড়ানো শোকার্ত নারী পুরুষেরা হাউমাউ করে যা বলল, তাতে আমার ঝলমলে রোদ্দুরঘেরা সকালটাতে যেন মুহুর্তেই অন্ধকার অমাবস্যার রাত নেমে এলো৷ রাহেলা নেই! ওর পাষন্ড স্বামী আর লোভী, ঝগড়াটে আর হিংসুটে ননদ মিলে ওর গায়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে! ওর চিত্কার শুনে আশপাশের মানুষ ছুটে এসে আগুন নিভিয়েছে বটে, কিন্তু ততক্ষণে শরীরের বেশিরভাগই শেষ হয়ে গেছে চিরতরে৷ হাসপাতালে নিতে নিতেই নিষ্ঠুর এই পৃথিবী ছেড়ে ওপারের দিকে যাত্রা শুরু করেছে রাহেলা!

আমি বজ্রাহত হয়ে বসে পড়লাম৷ আমার চোখের সামনে ভাসতে লাগলো রাহেলার হাসি ভরা মুখের ছবি৷ কত যে সুখ দুখের কাহিনী উজাড় করে ঢেলেছে আমার কাছে! কখনো হাসিমুখে শুনতাম, কখনো মৃদু বকে আগে হাতের কাজ শেষ করতে তাড়া দিতাম৷ তাতে হয়ত তার মুখের প্রদীপ্ত সুর্যের উপর পাতলা সাদা মেঘ জমত ক্ষণকালের জন্য, পরক্ষনেই আবার সেই মেঘ সরে গিয়ে প্রখর রোদ্দুর খেলা করত শ্যামলা মুখখানিতে৷ আজ সেই রাহেলা নেই! চিরদিনের জন্য চলে গেছে অভিমানিনীর মত, কিভাবে বিশ্বাস করব আমি!

গলায় স্বর ফুট ছিলনা আমার, তবুও এক মহিলাকে জিজ্ঞাস করলাম,

‘ওর ভাই কোথায়? সে জানে তার বোনের খবর?’

‘হ আফা, অর ভাই আছাড়ি খাইয়া কানতাছে আর পুলিশের হাতে পায় ধরতাছে বইনের লাশের লাইগা, নিয়া মাডিডা য্যান দিতে পারে৷’

বোনের লাশ প্রার্থী অসহায় ওই যুবকটির জন্য করুণা হতে লাগলো আমার৷ তার দরিদ্র ঘরে ভাতের দাবিদার একজন বাড়বে বলে বোনের হাজারও আর্তি উপেক্ষা করেছে সে৷ বরং মানিয়ে গুনিয়ে স্বামীর সংসারকেই আপন করে নিতে কত বুঝিয়েছে বোনকে৷ আজ এসেছে বোনের লাশ নিয়ে যেতে! লাশের ভাতের দরকার হয়না, হাজারো চাহিদা মেটানোরও প্রয়োজন পড়েনা৷ বরং বোনটি লাশ হয়ে চিরকালের জন্য তার কাঙ্গাল ভাইটিকে দায়মুক্ত করে দিয়ে গেল!

চোখে আঁচলচাপা দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম ৷ এক রাহেলার চলে যাওয়ায় পৃথিবী তো থেমে নেই৷ অনেক কাজ পড়ে আছে ঘরে৷ ঘড়ি ধরে সেসব তো শেষ করতে হবে আমাকেই!

Facebook Comments