banner

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 845 বার পঠিত

 

জলে ভাসা পদ্ম

ফাতিমা মারিয়ম


আমি ক্লাস সেভেন এ পড়ার সময় আমার মা মারা যায়। দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর তার মৃত্যু হয়। মা’র খুব জটিল একটা রোগ হয়েছিল। ধরা পড়ার প্রায় দেড় বছর বেঁচে ছিলেন। ডাক্তাররা আমার মায়ের রোগ নিরাময়ের জন্য অনেক চেষ্টা করেছিল। কোন চিকিৎসাই মাকে সারিয়ে তুলতে পারছিল না! দিনদিন মা মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। মার মৃত্যু হয় হাসপাতালে।

আমাদের ছোট্ট সংসার……সুখের একটি রাজ্য। আমি মা আর বাবা। সব কিছুই কেমন যেন লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল। আমি আর বাবা ভীষণ একা হয়ে পড়লাম।

মা মারা যাওয়ার তিন মাস পর নানা-নানু, মামা-খালা, চাচা-ফুফুরা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়ে বাবা আর আমার একাকীত্ব ঘোচানোর জন্য আমার একজন ‘আম্মু’ নিয়ে আসল। খালামণি, নানু ও ফুফুরা সবাই মিলে নতুন মাকে ‘আম্মু’ বলে ডাকতে শেখাল। আমি তাই প্রথম থেকেই উনাকে আম্মু বলে ডাকি।

ধীরে ধীরে বাবা স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে। ছুটির দিনে আমাকে আর আম্মুকে নিয়ে বিভিন্ন আত্মীয় স্বজনের বাসায় বেড়াতে যায়। হঠাৎ কোন একদিন আমাকে এসে বলে, নিশু চল আমরা আজ বাইরে কোথাও খেতে যাব। কোথায় যাওয়া যায় বল তো?’ আমরা তিনজনে মিলে প্ল্যান করে কোথাও যাই। বাইরে অনেকক্ষণ থেকে বাসায় আসি। আমরা সবাই সবাইকে নিয়ে ভালোই ছিলাম।

কিন্তু আমার জন্য এই দিনগুলিও বেশিদিন রইল না।

দিন দিন আমার আম্মু যেন কেমন হয়ে যাচ্ছে! আমি মনে করতাম আমার সাথে উনার সম্পর্ক বেশ ভালো। আমি মনে প্রাণে উনাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছিলাম। ভাবতাম উনিও আমাকে সেইভাবেই গ্রহণ করেছেন।

ধীরে ধীরে উনি আমার প্রতি কেমন যেন অনীহা প্রকাশ করা শুরু করলেন। আমি বুঝতাম। কিন্তু কাউকে কিছু বলতাম না। কারণ আমি ভাবতাম আমি নিজেই হয়ত ভুল বুঝছি।

প্রায়ই আমি স্কুলে যাবার সময় টিফিন পেতাম না! বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে স্কুলে যেতাম। স্কুলের ক্যান্টিনে টিফিন কিনে খেতাম। বাসায় ফেরার পরও দেখতাম যে আমার জন্য কোন খাবার নেই।

দুপুরে বাসায় আম্মু আর আমি থাকি। বাবা সকালে নাস্তা খেয়ে অফিসে যায় আর ফেরে রাতে। তাই দুপুরে কি হয় না হয় তিনি জানেন না।

এ ঘটনা কয়েক দিন ঘটার পর আমি বাবাকে জানাই। বাবা কোন পদক্ষেপ নেয় না! তাই আমার প্রতি আম্মুর অবহেলা দিন দিন আরও বাড়তে থাকে।

এমন দিনও আমার যেত দুপুরবেলা বাসায় ফিরে যখন দেখতাম যে টেবিলে বা ফ্রিজে কোন খাবার নেই তখন পট থেকে মুড়ি নিয়ে শুকনো মুড়ি বা বিস্কিট খেয়ে দিন পার করেছি। রাতে বাবার সাথে বসে যখন ভাত খেতাম তখন আমি বাবাকে বুঝতেই দিতাম না যে আমি দুপুরে ভাত খাইনি।

আম্মুকে খুশি রাখার জন্য আমার বাবার আচরণেও দিন দিন পরিবর্তন আসছিলো। প্রায়ই দেখি আমাকে ছাড়া আম্মু আর বাবা বাইরে ঘুরতে যায়। তারা বাইরে গেলে আমি মন খারাপ করে থাকি। একা একা আমকে বাসায় রেখে যেতে কি আমার বাবার একটুও খারাপ লাগেনা?

বাবার প্রতি ক্ষোভ বাড়তে থাকে। আমার প্রতি বাবা এতটা উদাসী হয়ে গেল কিভাবে? আমিতো বাবার একমাত্র মেয়ে! এভাবে আরও কয়েক মাস কেটে গেল।

আমার বয়স কম। কতটুকুই বা সহ্য করতে পারি!! ফুফুকে সব জানালাম। ফুফু বাবার কাছে জানতে চাইলেন এসব হয় যে তুই কোন পদক্ষেপ নিস না কেন? বাবা ফুফুকে জানালো যে মিতা (আম্মুর নাম) ভীষণ খামখেয়ালী টাইপের! তাই ওকে বেশি কিছু বলি না!

ফুফু আমাকে উনার বাসায় নিয়ে আসল। ফুফুর বাসা থেকে স্কুল অনেক দূরে। বাসে করে আসা যাওয়া করতে হয়! ফুফু এবং আমাদের সবার ধারনা ছিল কিছু দিন গেলে বাবা এবং আম্মু এসে আমাকে নিয়ে যাবে। কিন্তু এক বছরের বেশি সময় হয়ে গেল বাবা আমাকে নিতে আসেনি।

দেড় দুই মাস পর পর আসে! খুব অল্প সময় থাকে। কিছু টাকা হাতে দিয়ে যায় (স্কুল ও কোচিং এর খরচ)। আমি বাসায় যেতে চাই কি না তাও কখনো জানতে চায় না! দেখে মনে হয় বাবা এখন বেশ সুখেই আছে। ফুফু আমাকে সব সময় বলেন-‘তুই নিজ থেকে কখনো যাওয়ার কথা বলবি না। আমরা দেখি তোর বাবা কি বলে?’ কিন্তু ফুফু জানে না, কেউ জানে না আমি সব সময় মনে মনে একটি আহ্বানের অপেক্ষায় থাকি! আমার বাবা একদিন আমাকে এসে বলবে-‘আয় খুকু আয়…!’

অনলাইন এক্টিভিস্ট

Facebook Comments