banner

বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 1387 বার পঠিত

 

চাইল্ড অ্যাবিউজ (চাইল্ড ফিজিক্যাল অ্যাবিউজ)

আফরোজা হাসান


চাইল্ড অ্যাবিউজ: পৃথিবীর সব বাবা-মা’রাই সন্তানের ভালো চান। সন্তান যাতে ভালো হয় তার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেন। কিন্তু শিশুদেরকে নিয়ে কাজ করতে গিয়ে বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার।

শিশুদের বৈচিত্র্যতার চেয়েও বেশি দেখেছি বাবা-মাদের বৈচিত্র্যময় আদর-সোহাগ-ভালোবাসা এবং শাসন-শোষণ। জেনে বা না জেনে কিংবা বুঝে বা না বুঝে বাবা-মারা বাচ্চাদের উপর নানা ধরণের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করেন।

শারীরিক আঘাত চোখে দেখা যায় তাই পরবর্তীতে বাবা-মা তাতে মলম লাগাতে পারেন বা চেষ্টা করেন।

কিন্তু মানসিক আঘাত………!!!

এই আঘাতের কারণেই হয়তো শিশুদের মানসিকতার সঠিক বিকাশ বাধাঁপ্রাপ্ত হয়। কারণ বিভিন্ন ইন্দ্রীয়ের সাহায্যে শিশুরা বিভিন্ন বস্তুগত গুণাবলী ও ঘটনা সম্পর্কে ধারণা বা উপলব্ধি করতে শেখে।

আর এর উপর নির্ভর করেই শিশুদের মধ্যে জন্ম নেয় স্মৃতিশক্তি, কল্পনাশক্তি, সৃজনশীলতা, বিচারবুদ্ধি ইত্যাদি।

আমার পরিচিত একটি বাচ্চা আছে।

১.বাচ্চাটা কোন কিছুতেই মনোযোগ দিতে পারেনা, ২.স্থির হয়ে বেশিক্ষণ এক জায়গায় বসতে পারে না, ৩.কোন কিছু করতে বললেও ঠিকমতো করতে পারেনা,৪.একটুতেই রাগ করে-কান্না করে, ৫.বেখেয়ালি তাই খুব ভুল করে বা ভুলে যায়।

বাচ্চাটির বাবা-মাকে যদি পরামর্শ দেয়া হয় যে, ছেলেকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান তারা দুজনই ভীষণ বিরক্ত হন বা রাগ করেন। মোটকথা তারা মানতেই রাজী না যে তাদের বাচ্চাটি এডিডি বা এটেনশন ডেফিসিট ডিজঅর্ডারের শিকার। কেউ বোঝাতে গেলে উল্টো তাদের সাথে মনোমালিন্য হয়। অথচ সন্তানের প্রতি তাদের ভালোবাসার কোন কমতি নেই। বাচ্চা যা চাইছে বলার সাথে সাথে তা সামনে এনে হাজির করেন। কিন্তু মানুষ বলবে যে তাদের বাচ্চাটা স্বাভাবিক না, সে ভয়তে বাচ্চাকে ডাক্তারের কাছে নিতে চায় না বা নিজেরাও মানতে চায়না।

প্রতিবেশী একজনকে দেখেছি বাচ্চা কিছু করতে না চাইলে, নানাভাবে ভয় দেখিয়ে সে কাজটি করতে বাধ্য করে। কেউ আছেন সারাক্ষণ টিভি চ্যানেল আর ফোনালাপ নিয়ে এতো ব্যস্ত থাকেন যে, তখন বাচ্চা কথা বলতে চাইলে ধমক দিয়ে আরেক দিকে পাঠিয়ে দেন।

একজন মাকে দেখেছি বাংলাদেশ থেকে জালিবেত নিয়ে এসেছেন তার পাঁচ বছর বয়সি মেয়েকে শায়েস্তা করার জন্য। এক মা বুকফাটা কান্নার সাথে জানিয়েছিলেন, সাত বছর বয়সি ছেলেটাকে তাঁর স্বামী সামান্য কারণেই মাথায় তুলে সোফা বা বিছানায় ছুঁড়ে ফেলেন, কখনো লাথি দেন আর বাকিটা নাহয় নাই বললাম।

যে কোন ধরণের আচার-ব্যবহার-কাজ যা শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ বা ভালো থাকায় বাঁধা দেয়, তাকেই এককথায় চাইল্ড অ্যাবিউজ বলে।

চাইল্ড অ্যাবিউজকে চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে-

♠ফিজিক্যাল অ্যাবিউজ বা যে কোন ধরণের নিয়ন্ত্রণহীন শারীরিক আঘাত।

♠সেক্সুয়াল অ্যাবিউজ বা শিশু এবং প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে যে কোন রকমের যৌন সংসর্গ।

♠বিহেবিয়ার অ্যাবিউজ বা শিশুর প্রতি অবহেলা-অমনোযোগিতা।

♠ইমোশনাল অ্যাবিউজ বা নানাভাবে শিশুকে বাধ্য করা।

এই প্রত্যেকটি কারণের দ্বারাই শিশুদের স্বাভাবিক বিকাশ বাঁধাপ্রাপ্ত হয়। আমি আমার অভিজ্ঞতার আলোকে এই প্রত্যেকটি কারণ নিয়েই আলোচনা করবো।

চাইল্ড ফিজিক্যাল অ্যাবিউজ

সন্তানদের ভালোর জন্যই প্রয়োজনে
বাবা-মাকে দৃঢ় হতে হয়। এটা অবশ্যই ভালো কারণ বাবা-মার দৃঢ়তা সন্তানদের মনে নিরাপত্তা বোধের জন্ম দেয়।

কিন্তু ছেলেমেয়েরা যখন কথা শোনে না বা অবাধ্যতা করে, তখন তাদেরকে সঠিক পথে আনতে বাবা-মারা যে কাজটি করেন, তাঁর নাম ‘শাসন’।

আর শাসন মানে সবাই মনে করেন যে, বকাঝকা করা নয়তো কোন শারীরিক শাস্তি দেয়া কিংবা পছন্দের জিনিস বন্ধ করে দেয়া ইত্যাদি।

আর শাসনের পক্ষে নানা ধরণের যুক্তিও থাকে বাবা-মার কাছে। যেমন- মাঝে মাঝে শাসন না করলে বাচ্চারা মানুষ হয় না, সাহস বেশি বেড়ে যায়, ছোটবেলায় আমাদের বাবা-মা’রাও আমাদেরকে শাসন করেছেন ইত্যাদি ইত্যাদি।

অথচ শাসন আর গায়ে হাত তোলা কিন্তু এক জিনিস নয়। বাচ্চাদের ভুল বা অন্যায় গুলো অবশ্যই তাদেরকে ধরিয়ে দিতে হবে, তবে এরসাথে গায়ে হাত তোলার কোন সম্পর্ক নেই।

আমি দেখেছি আড়াই বছর বয়সি একটি মেয়েকে তার বাবাকে ঘর ভর্তি মানুষের সামনে চড় লাগিয়ে দিতে, মেহমানদের জন্য সাজিয়ে রাখা খাবার ধরার জন্য।

মেয়েটা ফ্যালফ্যাল করে বাবার দিকে তাকিয়ে ছিল, কারণ চড়টা কেন খেল বুঝতে পারছিলো না।

বাসায় টিচার আসলে পড়তে চায় না তাই চার বছর বয়সি মেয়েকে মা লাঠি পেটা শুরু করলো টিচারের সামনেই।

স্কুল থেকে ডেকে টিচাররা অভিযোগ করলো ক্লাসে বাচ্চা অমনোযোগী থাকে, বাসায় ফিরেই বাবার চড়-থাপ্পড়ের বৃষ্টি বাচ্চার উপর।

ছয় বছর বয়সি ছেলেটা তার তিন বছরের বোনের সাথে খেলনা শেয়ার করতে রাজী না হলেই শারীরিক আঘাতের স্বীকার হয়। ঘরের কোন জিনিসপত্র নষ্ট করলো তো আর রক্ষা নেই। এমন আরো অসংখ্য ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটে বাচ্চাদের সাথে।

অথচ এই ব্যাপার গুলোর সমাধানের সাথে শারীরিক আঘাতের কোন সম্পর্ক নেই বা শারীরিক আঘাত এর সমাধানও নয়।

পরীক্ষায় নাম্বার কম পেলে, ঘরের কোন জিনিস নষ্ট করলে, ছোট ভাই-বোনের সাথে বনিবনা না হলে, কথা শুনতে না চাইলে, অবাধ্যতা করলে বাচ্চাদের বুঝিয়ে না বলে,

গায়ে হাত তুললে আসলে তেমন কোন লাভ হয় না।

শরীরে ব্যথা পায় কিন্তু কেন ব্যথা পেলো বুঝতে পারে না, ফলে একই কাজ বার বার করে এবং আবারো শাস্তি পায়।

এর ফলে বাচ্চাদের মনে বাবা-মায়ের প্রতি চাপা ক্ষোভের সৃষ্টি হয় এবং ক্রমাগত তা বাড়তে থাকে।

একটা সময় বাচ্চারা বাবা-মার কথাই সহ্য করতে পারে না। ইচ্ছে করে তখন কথা শোনে না বা দুষ্টুমি করে। কারণ চিন্তা থাকে বড়জোর আমাকে ধরে মারবে এই তো!

তাই বাচ্চারা কোন অন্যায় করলে তাদের বোঝাতে হবে। কেন এই কাজটা করা ঠিক না, এর প্রভাব কি হতে পারে ইত্যাদি। আর শারীরিক আঘাতের চেয়ে এই বোঝানোটা অনেক বেশি ফলপ্রসূ।

শাসন আর অ্যাবিউজ কিন্তু এক জিনিস না। শাসন হচ্ছে এমন একটি পদ্ধতি যার মাধ্যমে শিশুর ভুল বা অন্যায় গুলো তাকে ধরিয়ে দিয়ে, তার থেকে বের হবার প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহযোগিতা করা।

কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে শাসনের নামে বাচ্চারা অ্যাবিউজের স্বীকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত, যার ফলে বাঁধাপ্রাপ্ত হচ্ছে তাদের সুষ্ঠু বিকাশ।

বাবা-মা যখন শাসন করতে গিয়ে বাচ্চাদের গায়ে হাত তুললেই যে সব ঠিক হয়ে যাবে এর কিন্তু কোন গ্যারান্টি নেই।
বরং বাচ্চারা আরো জেদি হয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক।

যারা বাচ্চাদেরকে বোঝাতে পারেন না বা শেখাতে পারেন না তারাই আসলে শাসনের নামে গায়ে হাত তোলেন। কিন্তু এভাবে সন্তানদের মানুষ করা যায় না।

নিজেদের চরিত্রের অযোগ্যতা, নিয়ন্ত্রণহীনতাকে শাসনের নামে চালিয়ে দেন। যা কিনা প্রকৃত অর্থে চাইল্ড ফিজিক্যাল অ্যাবিউজ।

আজ যে বাচ্চাটাকে আমি সামান্য কারণে গায়ে হাত তুলছি, শরীরের সাথে সাথে ছোট্ট মনটাকেও করছি আঘাতে আঘাতে জর্জরিত…!!

যখন ওর স্নেহ- মমতা-সহমর্মিতা-ভালোবাসার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, তখন পাচ্ছে শাসনের নামে চড়-থাপ্পড়-বকাঝকা…!!

একটা বয়সে গিয়ে যখন আমার স্নেহ-মমতা-সহমর্মিতা-ভালোবাসার প্রয়োজন পড়বে, তখন কি সন্তানের কাছ থেকে সেটাকে প্রাপ্য মনে করাটা অন্যায় হবে না?

আমার আজকের আচরণটাই যে আমার সন্তানের আগামীর পাথেয় হবে সেটা যেন আমরা কেউ ভুলে না যাই।

সাইকোলজি(পিএইচডি)

Facebook Comments