banner

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 556 বার পঠিত

 

‘ছায়া সঙ্গী…’ ফাতিমা শাহীন

আমি প্রায় প্রতিদিনই রোদ কিংবা বৃষ্টিতে নারীটিকে ম্যাপল গাছটির নিচে বসে থাকতে দেখতাম!

আমার ছেলেমেয়ে দুটি খুবই দুষ্টু হয়েছে। একটি বছরও হয়নি ওদেরকে এই স্কুলটিতে ভর্তি করিয়েছি , এরই মধ্যে এ দুটো চঞ্চলমতি হিসেবে স্কুলে নাম করে ফেলেছে। প্রতিদিন স্কুল ছুটির পর এ দুটো আমার কাছে আসতে আসতে নালিশের তুফান তুলে ফেলে। ওদের সামলাতে সামলাতে যখন পার্কিংয়ে রাখা গাড়ির দিকে এগোই, তখনও নারীটিকে স্থির ও অচঞ্চল ভাবে একই জায়গাতেই বসে থাকতে দেখি। মাঝে মাঝে কৌতুহলে ফেটে পড়তে চাইতাম, ইচ্ছে হত তার পাশে গিয়ে বসি, কথা বলি। কিন্তু কখনই কাউকে তার সাথে কথা বলতে ও মিশতে না দেখে ইচ্ছেটাকে আবার নিজের মাঝেই দমিয়ে ফেলতাম। 

আমার বাচ্চা দুটো ছুটির ঘন্টা বাজলেই বুলেট গতিতে ক্লাস থেকে বেরিয়ে পড়ত, তাই নারীটির সন্তানকে তার কাছে ফেরার দৃশ্য কখনই আমার দেখা হতনা। মাঝে মাঝে হয় এরকম, ক্লাস শেষ হবার পর বই ব্যাগ গুছিয়ে শান্ত সুবোধ বাচ্চারা ধীরে সুস্থে অপেক্ষায় থাকা বাবা মায়ের হাত ধরে বাড়ীর পথ ধরে। সবাই তো আর আমার দুটোর মত অস্থিরমতি চঞ্চল চড়ুই পাখিটি নয়!

তবে, সন্তানের জন্য অপেক্ষায় থাকা মায়ের চোখ যেমন সন্তানের আগমন পথের দিকে তাকিয়ে প্রতীক্ষার ক্ষণ গুনে চলে, তাঁর চোখে কি আমি কখনো তেমন প্রতীক্ষা দেখেছি? দেখেছি হয়তবা, অথবা দেখিনি! তার দৃষ্টি যেন পথ হারিয়ে যাওয়া পাখির মত সুদুর পানেই বিদ্ধ থাকত সারাক্ষণ। বয়স তাঁর কপালে গভীর কয়েকটি বলিরেখা এঁকে দিয়েছিল, যা হয়ত সাক্ষ্য দিয়ে যাচ্ছিল তার ফেলে আসা অতীতের, সুখে দুখে মেশানো বিপুল অভিজ্ঞতার! 

সময় কেটে যেতে লাগলো সময়ের নিয়মেই। ম্যাপল গাছটির পাতাগুলো তাদের তারুণ্য হারিয়ে সময়ের সাথে সাথে জীর্ণ হতে লাগলো। উষ্ণ বাতাসে একসময়ে লাগলো শীতল স্পর্শ। কিন্তু নারীটির অবস্থান বদলায়নি কখনই। এমনকি অন্যরাও ওই বেঞ্চটি বাদ রেখে অন্য কোথাও বসত বা জায়গা না পেলে দাঁড়িয়ে থাকত। কিন্তু বেঞ্চটি খালি থাকলেও কাউকে কখনো ওখানে বসতে দেখিনি। ভেততে ভেতরে আমি ভীষণভাবে তাঁর ব্যাপারে কৌতুহলী হয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু তাঁর কাছে গিয়ে, তাঁর পাশে বসে সেই কৌতুহল নিবৃত্ত করার সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারছিলাম না কিছুতেই!

এমনি সময়ে ঘটনাটি ঘটল। তখনও স্কুল ছুটি হয়নি, একটি ছোট বাচ্চা লাফাতে লাফাতে এগিয়ে আসতে গিয়ে হঠাত জুতার ফিতায় পা বেঁধে হাঁটু মুড়ে আছড়ে পড়ল সিমেন্টের বাঁধাই করা চত্বরটিতে, ওই নারীটির ঠিক সামনেই! ছোট্ট শিশুটির এই আকস্মিক আঘাতপ্রাপ্তি যেন পাথরের একটি প্রতিমাকে জাগিয়ে তুলল নিমেষে! নারীটি ছুটে গিয়ে বাচ্চাটিকে তুলে বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরে হাউ মাউ করে কাঁদতে লাগলো। আমি তো ঘটনার আকস্মিকতায় বিস্ময়ে বিমূঢ়! আমার মত অনেকেই ভেতরে ভেতরে নারীটিকে নিয়ে কৌতুহলী হয়ে উঠেছিলেন হয়ত! আমাদের এতদিনের কৌতুহলের নিবৃত্তি ঘটল অবশেষে। স্কুল অফিসের রিসেপশনিস্ট মাঝবয়েসী মিসেস গিলবার্ট আমাদেরকে যা বললেন তা শুধু বিস্ময়ের ই নয়, বরং করুণ, মর্মন্তুদ ও হৃদয়স্পর্শীও বটে!

নারীটির ছেলে এই স্কুলেই পড়ত। বছর পাঁচেক আগে ক্যাম্পিং এ গিয়ে সবার চোখের আড়ালে বন্ধুদের সাথে বাজী ধরে সাঁতার কাটতে গিয়ে খরস্রোতা নদীতে ভেসে গিয়েছিল। ব্যাপক অনুসন্ধান করে দুদিন পর তার নিরব নিস্পন্দ দেহ পাওয়া গিয়েছিল সেখান থেকেও প্রায় ৬/৭ কিলোমিটার দূরের একটি জায়গায়। সেই থেকে নারীটি হারিয়ে ফেলেছেন তার জীবনের স্বাভাবিকতা। আগে তিনি তাঁর নাড়ীছেঁড়া ধনকে পরম মমতায় সঙ্গে নিয়ে ঘরে ফিরতেন, আর গত পাঁচটি বছর ধরে তিনি প্রতিদিনই এসে ম্যাপল গাছের নিচে পাতা বেঞ্চটিতে আগের মতই এসে বসে থাকেন, কিন্তু ঘরে ফেরার সময়টিতে তিনি ফেরেন একাকী, এক বুক যন্ত্রণা ও নি:সঙ্গতাকে সাথী করে! আর এতগুলো বছর ধরে তার অকূল অসীম বেদনার মূক সাক্ষী হয়ে ম্যাপল গাছটি পরম মমতায় তাঁর ছায়াসঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে বছরের পর বছর ধরে! এ যেন ‘ মাদার অফ ম্যানভিল ‘ এর উল্টো প্রতিরূপ! 

আমি নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম অসম এই দুই সঙ্গীর দিকে। আমার ভাবনায় সাড়া দিতেই যেন পাতা ঝরার এই শেষ লগ্নেও যে কয়টি শুকনো নির্জীব পাতা প্রাণপনে পরম আশ্লেষে আঁকড়ে ধরে ছিল গাছের শাখা, আজ সেই পাতা কটিও যেন তাদের জীবনের শেষ প্রান্তে এসে হাহাকার ভরা হৃদয়ের ওই শোকাতুরা মায়ের গায়ে ঝরে পড়ল হালকা হিমেল হাওয়ায়, যেন বা সান্ত্বনাই পরশ বুলিয়ে দিল তাঁকে, আর সব নিয়ে বেঁচে থাকা মানুষগুলোকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে গেল যে কত স্বল্পস্থায়ী আমাদের জীবন, কতইনা ক্ষীন আমাদের আয়ুষ্কাল! হায়, সময় থাকতেই যদি আমরা বুঝতাম ……..! 

Facebook Comments