banner

মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 460 বার পঠিত

 

“সায়াহ্নের দ্বীপশিখা” -ফাতিমা খান

বাড়ীওয়ালার ছেলের বউ আজও বাখুর জ্বালিয়েছে। বিশেষ কিছু সুগন্ধী পাথর বা স্যান্ডেল কাঠের গুড়োর সাথে আরো কি সব তেল টেল মিশিয়ে যেন বাখুর তৈরি হয়। এগুলোকে জ্বলন্ত কয়লার টুকরার উপর রেখে জ্বালানো হলে খুশবুওয়ালা ধোয়া বের হয়। আরবদের আভিজাত্যের অংশ এই বাখুর। আমি নিজেও মাঝে মাঝে জ্বালাই। সুগন্ধী বাখুরের চেয়ে আমার ভাল লাগে ওদের বাখুরদানী গুলো। স্বর্ণ, রূপা বা অন্যান্য ধাতু বা চীনামাটিতে খোদাই করে ডিজাইন করা শৌখিন জিনিস, সেইরকম গর্জিয়াস! রাত গভীর হলে বাড়ী ওয়ালার ঘরে এই বাখুর জ্বলে। তাদের অন্দরমহল ছাপিয়ে বাখুরের খুশবু প্রায়ই আমার ঘরে চলে আসে। আমি চোখ বন্ধ করে থাকি। ভদ্রমহিলাকে এই স্বর্গীয় সুগন্ধীর ট্রেড নেইমটা জিগেস করতে হবে। পুরাই মাতাল করা খুশবু!

ধোয়া ওঠা চা নিয়ে বসেছি। “সোনালি ফয়সালা” বইটা সাথে, চমৎকার শিক্ষনীয় বই। রাত বাজে একটা সাঁইত্রিশ। চায়ের পানিতে বলগ আসার আগে একটু খানি এলাচ গুড়া মিশিয়েছিলাম। আধো রাতে এই লা-জাওয়াব স্বাদের এলাচ চা আমার খুব পছন্দের। “You can never get a cup of tea large enough or a book long enough to suit me “-কথাটা কে বলেছেন মনে নেই, কিন্তু আমার জন্য একশ ভাগ সত্যি ।

আজ সারাদিন শুধু সত্তর বছর বয়সী Alzheimer এ আক্রান্ত রোগীটার কথা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। ভদ্রমহিলা আমার কাছে এসেছিলেন হুইল চেয়ারে করে।মিষ্টি গোলগাল চেহারা। মায়াবী চোখ দুটোতে উদাস চাহনী। দাঁতের কোন কমপ্লেইন তিনি বলতে পারেন নাই। উনার এ্যটেন্ডেন্ট ছিল ছেলের বউ। তিনিই বলতে শুরু করলেন ঠিক এভাবেই…

“ডক্টর, আমার শ্বাশুড়ী ডিমেনশিয়ায় ভুগছেন প্রায় দশ বছর। অবস্থার অবনতিই কেবল হচ্ছে দিনকে দিন। এখন তেমন কিছুই তিনি মনে রাখতে পারেন না। এমনকি কখনও কখনও আমাদেরকেও চিনতে পারেন না। আজ দুদিন ধরে দেখছি রাতের বেলা মুখের ভেতর একটু পরপর আংগুল দেন। কি হয়েছে জানতে চাইলে বলেন, কই কিছুই তো হয়নি। কাল রাতে তাই আমি উনার পাশেই বসেছিলাম, শুধু এটুকু বোঝার জন্য যে উনার ঠিক কোথায় সমস্যা হচ্ছে। টু এক্সক্লুড দা ডেন্টাল প্রব্লেম, আপনার কাছে নিয়ে এসেছি। ”

রোগী দেখতে দেখতে ছেলের বউ এর সাথে অনেক কথাই হল। ত্রিশোর্ধ এই ভদ্রমহিলা মক্কার বাসিন্দা। জেনেটিক্স এ রিসার্চ করছেন। স্বামী ফরেন মিনস্ট্রি তে কর্মকর্তা, অফিসের খাতিরে আমেরিকা গিয়েছেন সফরে। বিয়ের পর থেকে শ্বাশুড়ির দেখাশোনা নিজেই করেন। ডিমেনশিয়ার কারণে দ্রুত সব কিছু ভুলে বসেন বলে একসময় পরিবারের সদস্যদের সাথে মায়ের ঝামেলা হয়ে যেত বেশ। শেষ পর্যন্ত এই ছেলের বউ তাকে নিজের কাছে নিয়ে আসেন। শ্বাশুড়ীর প্রতি নিজের এই যত্নশীলতাকে তিনি খুব সহজ অথচ ভারী একটা ইবাদত বলেই মনে করেন। খুব সাবলীল ভাবেই বললেন, ” তিনি আমার জীবনের সাথে জড়িয়ে থাকা ইবাদত। হয়ত আমি প্রতিদিন কাবাঘরে যেতে পারিনা, কিন্তু আমি আমার মালিকের একজন অসুস্থ বান্দার সেবা করতে তো পারছি, বিনিময়টা আল্লাহর কাছেই চেয়ে নেব। ”

আমি মুগ্ধ!
এত সুন্দর মানসিকতা শুধু জ্ঞানীদেরই কি হয়?

সোনালী ফয়সালা বইটায় মন দেওয়ার চেষ্টা করছি। বাখুরের খুশবু এতক্ষণে বাতাসে মিলিয়ে গিয়েছে। বইটা দ্রুত শেষ করতে হবে.. একটানে পড়ে যাওয়ার মতই একটা বই। শেষ না করে আজ ঘুমও আসবে না!

Facebook Comments