banner

শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 389 বার পঠিত

 

দাম্পত্য – ৭

দাম্পত্য সিরিজটা আদৌ আর চালাব কি না তা নিয়ে সবসময়েই দোনোমনায় থাকি। কিন্তু পথ চলতে চলতে একেকটা বিষয় চোখে পড়ে, যা নিয়ে প্রায় প্রতি পরিবারেই কিছু না কিছু সমস্যা হয়, তখন মনে হয়, নাহ! লিখি। আর কিছু না হোক, বিষয়টা নিয়ে চিন্তা ত করা হবে।

স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কটা এত বেশি জড়ানো, একে অপরকে নিয়ে, আর তার মাঝে আবেগ ভালবাসার দাবি এত বেশি, যে কোন মূহুর্তে আবেগটুকু, চাওয়াটুকু বদলে যেতে পারে ঈর্ষায়। এরকম দম্পতি প্রচুর আছে, বোঝাপড়া খুব ভাল, একজন অপরজনকে ভালও বাসে অনেক, কিন্তু তাদেরই কোন এক বিপরীত লিঙ্গের বন্ধু বা সহকর্মীর সাথে হৃদ্যতাটা একটু বাড়াবাড়ি মনে হয়। সব ঠিকঠাক, কেবল ঐ বন্ধুটির সাথে মিশলেই স্ফুলিঙ্গের মত ভেতরে জ্বলে ওঠে কী যেন। এই ঈর্ষা বুঝিয়ে বলাও যায়না। ব্যাখ্যা করা যায়না, ঈর্ষান্বিত ব্যক্তিটি হয়ত ‘আমি তোমাকে খুব ভালবাসি’ এই যুক্তিতে সাফাই গাইতে চাইবে, কিন্তু অপরজন এটিকে দেখবে হীনমন্যতা, বিশ্বাসের অভাব – এভাবেই। এখানে অন্যান্যবারের মত উভয়পক্ষ নিজেকে খোলাখুলি ব্যক্ত করলেও সমস্যার সমাধান হচ্ছেনা। এবং অবধারিতভাবে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা কমে যাচ্ছে।

আমি সবসময়েই কোন সমস্যা দেখলে তা সমাধান করার আগে উৎসটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করি। আমার কাছে মনে হয়েছে সামাজিক মেলামেশার ক্ষেত্রে স্বামী আর স্ত্রীর সীমানাটা যদি ভিন্ন হয়, তখন এই সমস্যার সূত্রপাত হয়। ধরুন আপনি ঢাকা ইউনিভার্সিটি/বুয়েটে পড়েছেন, সহপাঠীর সাথে এক রিকশায় ওঠা আপনার জন্য খুবই সাধারণ ব্যাপার। আপনার স্বামী/স্ত্রী হয়ত এ ব্যাপারটায় অভ্যস্ত না, তার কাছে দৃষ্টিকটু লাগছে। মানসিক টানাপোড়েনে বন্ধুর সাথে কথা বললেন অবলম্বন চাইতে, বন্ধুর স্বামী/স্ত্রী হয়ত ব্যাপারটা স্বাভাবিক ভাবে নিল না। আপনার স্ত্রী সোশ্যালাইজ করতে পছন্দ করে, আপনি ভালবাসেন নিজের মত থাকতে, আপনার পছন্দকে সম্মান জানিয়ে স্ত্রী যদি একাই সোশ্যালাইজ করতে শুরু করে, কিছুদিনের মধ্যে একটু ঈর্ষা, একটু সন্দেহ মনে চলে আসতেই পারে।
এজন্য এই বিষয়ে পরিষ্কারভাবে কথা বলা খুবই জরুরি, সমস্যা শুরুর আগেই। সবচেয়ে ভাল হয় বিয়ের আগেই না হলে সম্পর্কের শুরুর দিকেই কথা বলে নিলে। এমনি এমনি কোন প্রসঙ্গ ছাড়া আলোচনা করা ত কঠিন, আপনি চাইলে বানিয়ে বানিয়ে আপনার কোন বন্ধুর উদাহরণ দিতে পারেন, ‘ওদের এমন হচ্ছে, তুমি কি মনে কর?’ তখন এর পক্ষে বিপক্ষে যুক্তি আসবে, হয়ত অপরজন বলবে, ‘বিয়ের পরে এত মেলামেশা কী?’ অথবা, ‘বিশ্বাস থাকলে এগুলো আবার কোন সমস্যা নাকি?’ – এভাবে আপনি জানতে পারবেন নারী পুরুষের স্বাচ্ছন্দ্যের ঠিক কোথায় আপনার অবস্থান আর কোথায় আপনার সঙ্গীর।

দ্বিতীয় যে কারণটা আমার মনে হয়েছে গুরূত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে ইনসিকিউরিটি। আপনার সঙ্গী/সঙ্গিনীর সর্বাবস্থায় আপনিই একমাত্র অবলম্বন আর থাকছেন না – এই বোধটা খুব ভয়ের। আমি ছাড়া আরও কারো সান্নিধ্য তার ভাল লাগতে পারে – এ ব্যাপারটা মানতে যেন খুব কষ্ট হয়। এ ধরণের ঈর্ষা শুধু বিপরীত লিঙ্গের মানুষদের মধ্যেই সীমিত থাকে না, টেলিভিশন, বই, পোষা প্রাণী, এমনকি নিজের সন্তানদের প্রতিও ঈর্ষা আসতে পারে। এই ঈর্ষাটা মূলতঃ ওখান থেকে আসে, যেখানে আপনি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন আপনার জন্য বরাদ্দকৃত সময়টুকু অন্য কেউ/ কিছু নিয়ে যাচ্ছে।

এ সমস্যা প্রতিরোধের উপায় কী? প্রথমেই চেষ্টা করতে হবে ইনসিকিউরিটি বোধটা দূর করতে। ছোটখাট সারপ্রাইজ, উপহার, তার পছন্দের কোন কাজ (যা আপনি আগে কোনদিন করেন নি) – এসব তার কাছে এই মেসেজটা পৌছাবে যে আপনি তার ছোটখাট সব ভাললাগার দিকেই লক্ষ্য রাখেন। ঈর্ষার উৎস যদি হয় কোন অভ্যাস, বা কোন বন্ধু, সচেতনভাবে তার সামনে কাজ দিয়ে প্রমাণ করুন যে প্রায়োরিটি লিস্টে ওসব কখনোই তার উপরে না। যেমন টিভি দেখার সময় সে কোন কথা বললে টিভিটা বন্ধ করে তার দিকে ঘুরে কথাটা শুনুন। বই পড়ার বেলায় বই বন্ধ করে মুখ তুলে তাকান। কয়েকবার এমন করলে সে মেসেজ পেয়ে যাবে, এর পর থেকে আপনি নরম সুরে বললেই হবে, আমি একটু পরে করি? সহজ! আর যদি ঈর্ষাটা কোন মানুষের বিরূদ্ধে হয়, চেষ্টা করুন এমন কোন ঘটনা এড়িয়ে চলতে যেখানে আপনার স্বামী/স্ত্রী বনাম বন্ধু – এদের মধ্যে কোন একজনের প্রোগ্রাম বেছে নিতে হয়। একই ট্রিকস বাচ্চাদের জন্যেও প্রযোজ্য। বাচ্চারা ঠিকই বুঝে ফেলে বাবা মা তাদের চেয়ে টেলিভিশন কে বা অন্য কিছুকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে কিনা। প্রতিশ্রুতি করে সেটা ভাঙলে কিছুতেই আপনার উপর শ্রদ্ধা বাড়বে না, এটা নিশ্চিত।

ঈর্ষার প্রথম কারণটা আমি মনে করি সমাধান করা বেশি কঠিন। যে রক্ষণশীল তার যেমন নিজের পক্ষে অনেক ভাল ভাল যুক্তি আছে, যে উদার, তারও আছে। অনেক সময় দেখা যায় মানুষ রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গিটাকেই ন্যায্য বলে ধরে নেয়, অপরজন তখন একই সাথে অপমানিত ও অসহায় বোধ করে। এই বোধ স্বামী স্ত্রীর মধ্যে থাকা খুবই বিপদজনক।কারণ তখন স্বাভাবিক আবেগ ভালবাসার পথ রূদ্ধ হয়ে যায়।

ত কী করতে হবে? যে রক্ষণশীল, তাকেই সহনশীল হতে হবে। কারণ জোর জবরদস্তি করে নিষ্পত্তি করার চেষ্টা করা বোকামি। সম্ভব হলে সরাসরি বলতে পারেন, ‘এই কাজগুলো আমি সহজভাবে নিতে পারিনা। আমার মধ্যে প্রচণ্ড ঈর্ষা তৈরি হয়, যা আমি নিয়ন্ত্রণ এ রাখতে পারিনা।’ তখন অপরপক্ষ স্বাভাবিকভাবেই বলতে পারে, ‘এটা তোমার সমস্যা, আমি কেন তার জন্য বন্ধুত্ব নষ্ট করব?’ আপনি তখন বুঝিয়ে বলতে পারেন যে ‘একটা পরিবার খুব রক্ষণশীল থেকে খুব উদার – যে কোন অবস্থানে থেকেই চলতে পারে। এটা আমার বা তোমার সমস্যা নয়, এটা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যের সমস্যা। আমি চেষ্টা করব তোমার মত করে চিন্তা করতে, কিন্তু তুমিও চেষ্টা কর এমন কোন সমস্যা যেন না হয় সেটা খেয়াল রাখতে।’ এর পাশাপাশি আপনি যাকে নিয়ে ঈর্ষান্বিত হন, তাকে নিয়ে আরো বেশি বেশি চিন্তা করে দেখুন, সে মানুষটার সব কিছুই কি খারাপ? নাকি একটু দু’টো কাজ আপনার ভাল লাগেনা। তখন আপনার সঙ্গীকে আরো পরিষ্কার করে বলতে পারবেন, ঠিক এই বিষয়গুলো তে আমার আপত্তি। কেন আপত্তি সেটাও চিন্তা ভাবনা করে নিশ্চিত হয়ে নিন। আপনি যদি এতখানি পরিশ্রম করেন, আপনার সঙ্গী বুঝতে পারবে যে আপনি সত্যিই সমস্যা সমাধানে আন্তরিক। তখন তার তরফ থেকেও আন্তরিকতা বাড়বে।

পরিশেষে, একটা চমৎকার দু’আ করুন দু’জনে মিলে, হে আল্লাহ! আমাদের মধ্যে যে ভুল পথে আছে তাকে তুমি শুধরে দাও, আর যে সঠিক পথে আছে তাকে ধৈর্য ধরার শক্তি দাও।

(পরের পর্বের জন্য “অপরাজিতার” সাথেই থাকুন)

নুসরাত রহমান
পিএইচডি(বায়োলজি)

Facebook Comments