চট্টগ্রাম নগরের পলোগ্রাউন্ড মাঠের উল্টো দিকের ফুটপাত। পাশাপাশি তিনটি চায়ের দোকান। এর একটিতে চা বানাতে ব্যস্ত দুই নারী। তাঁরা মা ও মেয়ে। গত ১৮ জুন গিয়ে এমন দৃশ্য দেখতে পেলাম। সঙ্গে ছিলেন ট্রাস্টের কর্মসূচি ব্যবস্থাপক। শেলী আক্তার নামের মেয়েটির মুখে সাবেক স্বামীর পৈশাচিকতার ক্ষতচিহ্ন, কিন্তু মনোবল ভাঙেনি তাঁর। অ্যাসিডদগ্ধ নারীদের জন্য সহায়ক তহবিলের সহযোগিতায় নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছেন তিনি।
নেশাগ্রস্ত স্বামীর অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে প্রায় দুই বছর আগে স্বামীকে তালাক দিয়েছিলেন শেলী আক্তার। স্বপ্ন দেখেছিলেন, নিজেই রোজগার করে স্বাবলম্বী হবেন। মায়ের সঙ্গে মিলে ছোট্ট একটি চায়ের দোকান দিয়েছিলেন। পুঁজি তেমন না থাকলেও কোনোভাবে কেটে যাচ্ছিল তাঁর জীবন। প্রতিহিংসাপরায়ণ সাবেক স্বামীর সেটি সহ্য হয়নি। গত বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর ভোরে অ্যাসিড ছুড়ে মারেন সাবেক স্বামী। তখন ঘুমিয়েছিলেন শেলী। ছুড়ে দেওয়া ওই অ্যাসিডে দগ্ধ হয়েছিলেন পাশে ঘুমিয়ে থাকা মা হোসনে আরা বেগমও (৫৫)।
অ্যাসিডদগ্ধ অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছিল মা-মেয়েকে। অ্যাসিডে শেলীর মুখ, মাথার এক পাশসহ শরীরের ১৫ শতাংশ পুড়ে যায়। মায়ের পুড়ে যায় শরীরের ১০ শতাংশ অংশ। হাসপাতালে ভর্তির পর চিকিৎসা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে শেলীর পরিবার। এ সময় শেলীর পাশে দাঁড়ায় ট্রাস্ট। প্রায় দুই মাস হাসপাতালে চিকিৎসা চলে শেলীর। চিকিৎসা সহায়তা হিসেবে শেলীকে অ্যাসিডদগ্ধ নারীদের জন্য সহায়ক তহবিল থেকে ৬০ হাজার টাকা দেওয়া হয়।
সুস্থ হওয়ার পর শেলীর পুনর্বাসনেও এগিয়ে এসেছেট্রাস্ট। অ্যাসিডদগ্ধ নারীদের জন্য সহায়ক তহবিল থেকে তাঁকে ৪০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। এ টাকা পেয়ে জীবনে ঘুরে দাঁড়ানোর সম্বল পান শেলী। এখন তাঁর স্বপ্ন, মর্যাদা নিয়ে বাঁচার। তিনি বলেন, ট্রাস্টের কাছ থেকে অর্থসহায়তা পেয়ে নতুনভাবে স্বপ্ন দেখার সাহস পেয়েছি। এই টাকা দিয়ে দোকানের জন্য টুল, চায়ের কাপ ও খাদ্যপণ্য কিনেছি।’ জানালেন, দিন শেষে খেয়ে–পরে বাঁচার মতো আয় করতে পারছেন এখন।
অ্যাসিড ছোড়ার মামলায় পুলিশ ঘটনার তিন দিন পর শেলীর সাবেক স্বামী মো. জাহাঙ্গীরকে ঢাকার রূপনগর এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে। ওই মামলায় জাহাঙ্গীরকে একমাত্র আসামি করে পুলিশ অভিযোগপত্র দিয়েছে। মামলাটি বিচারাধীন। শেলীদের মূল বাড়ি কুমিল্লার মুরাদনগরে। তাঁরা চট্টগ্রাম নগরে অনেক বছর ধরে থাকছেন। অভাবের কারণে শেলীর পড়াশোনা করা হয়নি। শেলীরা তিন ভাই, তিন বোন। বড় দুই বোনের বিয়ে হয়েছে। তাঁরা কুমিল্লায় থাকেন। বড় দুই ভাই ভ্যান চালান। ছোট ভাই স্কুলে পড়ে। পলোগ্রাউন্ড সিআরবি এলাকায় তাঁরা থাকেন। প্রায় ছয় বছর আগে শেলীর সঙ্গে জাহাঙ্গীরের বিয়ে হয়। জাহাঙ্গীরের মূল বাড়ি রংপুরে। তবে তিনিও পলোগ্রাউন্ড এলাকায় থাকতেন। শেলীর একটি ছেলে রয়েছে। বিবাহবিচ্ছেদের পর জাহাঙ্গীর ছেলেকে রংপুরে তাঁদের বাড়িতে রেখে আসেন। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পর ছেলেকে নিজের কাছে নিয়ে আসবেন—এখন সেই দিনটির অপেক্ষায় আছেন শেলী আক্তার।