banner

বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 598 বার পঠিত

 

প্রশিক্ষণ বদলে দিল শীলা, কাকলী, সাবিকুন্নাহারদের জীবন

টিনের চালের খোলা বারান্দা। সেখানে রাখা একটি কাঠের টেবিলে নেটের থান কাটছেন এক নারী। তিনি শীলা রানী। সফল একজন উদ্যোক্তা। নেটের ব্যাগ বানান আর সেগুলোর বিপণন করেন। এই ব্যবসায় তাঁর মাসিক আয় প্রায় ৫০ হাজার টাকা। শীলার সঙ্গে গ্রামের বেশ কয়েকজন নারীও কাজ করছেন। ৩২ বছর বয়সী এই নারীর জীবনের গল্প কিন্তু এমন ছিল না।
বিয়ের পর থেকেই শীলার সঙ্গী দারিদ্র্য আর স্বামীর নির্যাতন। স্বামী পক্ষাঘাতগ্রস্ত হলে তাঁকেই সংসারের দায়িত্ব নিতে হয়। তিনি গ্রাম থেকে গরুর দুধ সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করতে শুরু করেন। এ কাজ করতে গিয়ে তাঁকে মানুষের কটূক্তি, উত্ত্যক্ত আচরণ সহ্য করতে হয়েছে।
২০১৪ সালে এক প্রতিবেশীর মাধ্যমে শীলা জানতে পারেন ব্র্যাক দরিদ্র ও ঝুঁকিপূর্ণ নারীদের নারী উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলার জন্য একটি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে। তিনি এই ‘ইকোনমিক এমপাওয়ারমেন্ট ফর পুওর অ্যান্ড ভালনারেবল উইমেন ইন বাংলাদেশ (ইইপি)’ প্রকল্পের অধীনে সাত দিনের প্রশিক্ষণ নেন।
প্রকল্পের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক গোলাম মোস্তফা বলেন, নারায়ণগঞ্জের চারটি জায়গায় এ প্রকল্পে ৩ হাজার ৬০০ নারীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তাঁরা বিউটি পারলার, সবজি চাষ, মোমবাতি তৈরি, কাটিং ও সেলাই কাজ, নার্সারিসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেন। এ সময় জেন্ডার-বিষয়ক সচেতনতা তৈরিতেও ৩ হাজার ২৬০ জন নারী-পুরুষকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
গোলাম মোস্তফা আরও বলছেন, প্রশিক্ষণ পাওয়া ৩ হাজার ৩৩৮ জন নারী সরাসরি আয় করছেন। আর তাঁদের মধ্যে ১১ জন নারী মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জয়িতা পুরস্কার পেয়েছেন। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে এ প্রকল্প। শেষ হচ্ছে চলতি মাসেই।
শিলা রানী বলেন, ‘প্রশিক্ষণ নেওয়ার দুই দিন পরেই ৮০০ টাকা ধার করে ২০০ গজ নেটের থান আনি। নিজে কেটে নিজে সেলাই করি। সেই থেকে শুরু।’ শীলার স্বামী অসুস্থ কালিপদও এখন খুশি। তিনি বলেন, ‘আমি অসুস্থ। শীলা সংসার চালায়, আমার চিকিৎসার খরচ দেয়।’
এমন আরেক সফল উদ্যোক্তা সাবিকুন্নাহার। রূপগঞ্জের জাঙ্গীর গ্রামে তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তিনি ছাঁচে মোমের দ্রবণ ঢালছেন। সাবিকুন্নাহারও ব্র্যাকের এই প্রশিক্ষণে অংশ নেন। তাঁর মাসিক আয় প্রায় ৩০ হাজার টাকা। গরমকালে আয়ের পরিমাণ আরও বেড়ে যায়, বলেন সাবিকুন্নাহার।
সাবিকুন্নাহার সামাজিক কাজের অংশ হিসেবে গৃহনির্যাতন বন্ধে ঘরে ঘরে প্রচারণা ও পরিবারপ্রধানদের সঙ্গে আলোচনা করেন। পাশাপাশি তিনি গ্রামে বাল্যবিবাহ বন্ধেও সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন। ব্র্যাকের এক গবেষণা জরিপে দেখা যায়, দরিদ্র নারীদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও দক্ষতামূলক কাজে সম্পৃক্ত করলে আয় দ্বিগুণ হয়। ২০১৪ সালে প্রশিক্ষিত নারীদের আয়মূলক কর্মকাণ্ড ছিল ৩২ শতাংশ। ২০১৫ সালে তাঁদের এ আয় বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৬২ শতাংশে। ১ হাজার ৪০০ নারীর ওপর গবেষণাটি পরিচালিত হয়।
এ গবেষণায় আরও দেখা যায়, অর্থনৈতিক সক্ষমতার পাশাপাশি তাঁদের সিদ্ধান্তগ্রহণ ও সংসার পরিচালনায়ও দক্ষতা বাড়ে। এ ছাড়া অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী হওয়ার কারণে সমাজে তাঁদের মর্যাদা ও গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়।
আরেক নারী উদ্যোক্তা কাকলী আক্তার। তিনি ওড়নায় কারচুপির কাজ করেন। ২৭ জানুয়ারি তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তাঁর স্বামী সুতায় রং করছেন। কাকলীর স্বামী বলেন, আগে অন্য কাজ করতাম। আয় বেশি হওয়ায় দুজনেই এখন এ কাজ করি। কাকলী সফল উদ্যোক্তা হিসেবে জয়িতা পুরস্কার পেয়েছেন।
তবে গ্রামের নারীদের এ কাজ করতে গিয়ে কম বাধার সম্মুখীন হতে হয়নি। পরিবারই ছিল সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা। প্রশিক্ষণ নিতে দিতেই রাজি ছিল না অনেক পরিবার। তখন সেই পরিবারের শাশুড়িকে প্রশিক্ষণে যুক্ত করা হয়।
এ প্রসঙ্গে প্রকল্পের কর্মসূচি সমন্বয়কারী খালেদা খানম বলেন, নারী উদ্যোক্তাদের উন্নয়নের জন্য দরকার আত্মবিশ্বাস ও জেন্ডার-বিষয়ক সচেতনতা। এ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যেমন অনেক নারী অর্থনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। আবার পেয়েছেন সামাজিক মর্যাদা। পাশাপাশি, তাঁরা অন্য নারীদেরও কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করছেন। প্রকল্পের আওতায় নারীদের বাজার ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের (ব্যাংক) সঙ্গেও যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে তাঁদের ঋণ নেওয়া, কাঁচামাল সংগ্রহ, উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকরণ সহজ হয়েছে।

Facebook Comments