banner

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 456 বার পঠিত

 

দেশসেরা সবজিচাষি বেলি বেগম

শীতের সকালে গ্রামের মেঠোপথ দিয়ে হেঁটে সবজিচাষি বেলি বেগম সবজি খামারে এলেন। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, চোখ ভরে দেখছিলেন নিজের সবুজ খেত। এক ফসলি জমি ছিল এখানে। এখন সেই বিস্তীর্ণ খেতজুড়ে সবজির সমারোহ। সবজি চাষে বিপ্লব ঘটেছে এ গ্রামে। আর এই সবজি চাষে বিপ্লবের কারণে দেশসেরা সবজিচাষি হিসেবে ৭ জানুয়ারি কৃষিতে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন বেলি বেগম।
বেলি বেগম এখন দেশের একজন আদর্শ সবজিচাষি। পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার সলিমপুর ইউনিয়নের জগন্নাথপুর গ্রামে বেলি বেগমের বাড়ি। স্বামী সিদ্দিকুর রহমান। তিনিও জাতীয় পদকপ্রাপ্ত কৃষক। বেলি বেগম তাঁর নিজ চেষ্টায় শূন্য থেকে তিল তিল করে গড়ে তুলেছেন ‘বেলি কৃষি খামার’। ৪০ বিঘা জমির এই খামার বর্তমানে সবজি চাষের দেশসেরা অন্যতম আদর্শ খামার। এই খামার থেকে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য প্রতিবছর দেশের বিভিন্ন কৃষি কলেজ ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থী-শিক্ষক এবং ঢাকা খামার বাড়ির কৃষি কর্মকর্তারা আসেন। তাঁর এই কৃতিত্বের কাহিনি শোনালেন বেলি বেগম নিজেই।
বেলি বেগমের পুতুল খেলার বয়স পেরিয়ে যেতে না যেতেই বিয়ে হয়ে যায়। ১২ বছর বয়সে বিয়ে হওয়ায় ছোট ভেবে শাশুড়ি তাঁকে খুব আদর করতেন। পরিবারে ছিল অসচ্ছলতা। থাকতেন পাকশী রেল কলোনিতে। সেখান থেকে চলে আসেন সলিমপুরের জগন্নাথপুর গ্রামে। গ্রামের বাড়ির আঙিনায় শাশুড়ি চালকুমড়ার চাষ করতেন। হাটে বিক্রির পর সেই টাকার কিছু অংশ তাঁকে দিতেন। সেখান থেকে পুঁজি বানিয়ে বেলি বেগম প্রথমে ১০টি মুরগির বাচ্চা কেনেন। কিন্তু কষ্টে তাঁর প্রাণ কেঁদে ওঠে। কারণ, ১০টির মধ্যে ৮টি বাচ্চা মারা যায়। তবু বেলি বেগম হতাশ হননি। সেই দুইটি মুরগি বড় হয়ে ডিম দেয়। খুশিতে আত্মহারা হয়ে ওঠেন বেলি বেগম। এভাবে ডিম থেকে ৪০টি মুরগির বাচ্চা পান। ডিম বিক্রি করে ২ হাজার ৫০০ টাকা পুঁজি হয়। এরপর কিছু টাকা ঋণ করে কেনেন একটি গরু। ছয়-সাত মাস রাখার পর সেটি বিক্রি করে দেন। এরপর কেনেন ২৬ হাজার টাকায় একটি গাভি। এক বছর পর গাভি একটি বাচ্চা দেয়। সেটিও ছিল গাভি। সেই দুইটি গরু থেকে প্রতিদিন সাত কেজি দুধ পাওয়া যেত। এভাবে বছর খানেক পর তাঁর জগন্নাথপুর গ্রামের বাড়ির আঙিনায় তিন কাঠা জমিতে গড়ে তোলেন একটি কুলের নার্সারি। সেখান থেকে কুলের চারা বিক্রি করতেন। বেলি বেগম তাঁর সেই নার্সারি থেকে শুরু করেন কুলের চারা বিক্রির কাজ। ২০০৭ সালে তিনি প্রথম আয় করেন ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এভাবে ৪ বছরে তিনি ৪৭ লাখ টাকার চারা বিক্রি করেন।
নিজ নামে কেনেন এক বিঘা পাঁচ কাঠার একটি জমি। সেখানে গড়ে তোলেন সবজি ও ফলের বাগান। তাঁর এই সবজির খামারে বর্তমানে গাজর, লাউ, ফুলকপি, বাঁধাকপি, ধনেপাতাসহ নানা জাতের সবজি ও ফসল উৎপাদন হচ্ছে বিষমুক্ত পদ্ধতিতে। এখন আর বেলি বেগমকে অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয় না। খামার থেকে প্রতিবছর কয়েক লাখ টাকা আয় করেন।
বেলি বেগম বলেন, তাঁর এ সবজির খামার দেখে এলাকার অনেক নারী-পুরুষ উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। তাঁরাও গড়ে তুলেছেন সবজির বাগান।
তবে শুধু সবজি চাষই নয়, তিনি সামাজিক বিভিন্ন কাজের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রেখেছেন। বেলি বেগম তাঁর স্বপ্নের কথা বলতে গিয়ে বলেন, ‘আমি তো তেমন লেখাপড়া জানি না। কিন্তু একজন নারী শিক্ষিত হওয়ার পরও স্বামী বা অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকেন অনেক সময়। তবে আমি কষ্ট হলেও নিজ পায়ে দাঁড়িয়েছি। আমার মতো দেশের সব নারীকে এভাবে নিজের পায়ে দাঁড়ানো উচিত।’ বেলি বেগম বলেন, তাঁর স্বামীর পাশাপাশি তাঁর মেয়ে স্মিতা খাতুনও তাকে এ কাজে সার্বক্ষণিক সহযোগিতা করে। খামারে প্রতিদিন ৪০ জন শ্রমিক কাজ করেন। তাঁদের পারিশ্রমিক দেওয়া হয়। স্মিতা খাতুন খামার শ্রমিকদের নির্দেশনা দেয়।
ঈশ্বরদী উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা রওশন জামাল বলেন, বিষমুক্ত ও বাণিজ্যিকভিত্তিক সবজি উৎপাদনের পাশাপাশি বেলি বেগম দেশের একজন অন্যতম নারী কৃষি উদ্যোক্তা। তাঁকে দেখে সবাই অনুপ্রাণিত হচ্ছেন, এটা দেখে ভালো লাগছে।

Facebook Comments