banner

শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 370 বার পঠিত

 

পেশা সবজি টোকানো, ঠিকানা ফুটপাত

তাঁরা তিনজন হারুপা আক্তার, শেফালি বেগম ও রিমা আক্তার। তিনজনই ঢাকার কারওয়ান বাজারে সবজি টোকান। ট্রাক থেকে নামানোর সময় কিছু সবজি মাটিতে পড়ে। তাঁরা ঝাঁপিয়ে পড়েন সেগুলো কুড়াতে।

সপ্তদশ শতাব্দীতে চালু হওয়া এই পাইকারি বাজারটির নাম হয়েছিল মাড়ওয়ারি ব্যবসায়ী কারওয়ান সিংয়ের নামে। ঢাকা শহর যখন ঘুমোতে যায়, কারওয়ান বাজার  তখন জেগে ওঠে। সারা দেশ থেকে আসতে থাকে শাকসবজি, ফলমূলবোঝাই ট্রাক আর পিকআপ ভ্যান। রাতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে নারী-পুরুষের ব্যস্ততা।

রাত ১০টা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত বাজার ঘুরে এখানে কমবেশি শ তিনেক নারীকে কাজ করতে দেখা গেল। বাজারের ব্যবসায়ীদের মতে এঁদের সংখ্যা হাজার খানেক। দুই ঈদের আগে কাজের খোঁজে আসা নারীদের সংখ্যা বাড়ে।

এখানে কাজ করেন অল্পবয়সী নারী থেকে বৃদ্ধারা। নানা ধরনের কাজ আছে। সবজি টোকানো, ট্রাক থেকে সবজি আড়তে নেওয়া, পেঁয়াজের খোসা বাছা, আড়ত ঝাড়ু দেওয়া, পাইকারদের ফুটফরমাশ খাটা। অনেকেই বাজারঘেঁষা ফুটপাতগুলোতে থাকেন।

হারুপা আক্তারের বয়স তিরিশের কাছাকাছি। আট বছর বয়স থেকেই কারওয়ান বাজারের ফুটপাতে থাকেন। সবজি বিক্রি শেষে বস্তাটি মাথার নিচে দিয়ে ঘুমিয়ে যান। তাঁর তিন সন্তানের জন্মও এখানে। নিরাপত্তা নেই, তাই বড় দুই মেয়েকে গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছেন। স্বামী মাদকের ঝামেলায় এখন জেলে।

হারুপার কোমরে একটি কাপড়ের পুঁটলি বাঁধা। সবজি কুড়িয়ে প্রথমে এতে চালান করে দেন, পুঁটলি ভরে গেলে বস্তায় রাখেন। হারুপার সঙ্গে যাঁরা কাজ করেন, সবার কাজেরই এই তরিকা। রাত ১১টা থেকে ৪টা পর্যন্ত সবজি টোকান। এরপর তাঁরা বিক্রি করতে বসেন। বাজারের খুচরা বিক্রেতা ও অল্প পুঁজির ব্যবসায়ীরা এঁদের মূল ক্রেতা। ভোর ছয়টার মধ্যে সব বিক্রি হয়ে যায়। পাঁচ-ছয় শ টাকার মতো পাওয়া যায়।

শাহনাজ বেগম, অঞ্জনা বেগম, মরিয়ম খাতুন আর খোরশেদা বেগম কাজ করেন আড়তে। তাঁরা বস্তা থেকে ঝুড়িতে সবজি সাজিয়ে দেন, পাল্লা মাপতে সাহায্য করেন। কখনো পাইকারদের চা-পানি এনে দেন। বিনিময়ে পাইকাররা শেষ রাতের দিকে তাঁদের দাগ লাগা, পচা সবজি ও ফল বিনা মূল্যে দিয়ে দেন। একেকজন গড়ে চার-পাঁচজন পাইকারের কাজ করেন।

শাহনাজ বেগম আবার রোজ ১৫০-২০০ টাকার সবজিও কেনেন। পাইকারদের দেওয়া সবজির সঙ্গে এগুলো ভোরে বিক্রি করেন। আয় হয় শ পাঁচেক টাকা। সবজি সংগ্রাহক এই নারীরা সুযোগ পেলে একেক জায়গা থেকে দুই-একটা করে সবজি কোমরের পুঁটলিতে ভরে ফেলেন। কথাটা পাইকাররাও জানেন। পাইকার মাসুদ রহমান যেমন বলেন, ‘হাজার হাজার মালের তোন একটা-দুইটা নিলে কমে না। প্যাডের দায়েই তো করে।’

অনেক নারী টোকান না, রাতে সবজি কিনে দিনে বিক্রি করেন। তাঁদের একজন মনোয়ারা বেগম। তিনি বেচাকেনা করেন আলু। লাভ থাকে বস্তাপ্রতি ২০০ টাকা। মনোয়ারার স্বামী মৃত। দুই ছেলেকে নিয়ে তিনি পাকা বাজারের বারান্দায় থাকেন। বললেন, টাকা জমাচ্ছেন। জমি কেনার মতো টাকা হলেই জন্মভিটা জামালপুরে ফিরে যাবেন।

হারুপারা ফুটপাতে থাকেন, খান, ঘুমান। টয়লেট-গোসল সারেন বাজারের গণশৌচাগারে। তবে তাঁরা কেউ রান্না করেন না। তিন বেলাই খাবার কিনে খান। শেফালি বেগমের কথা, ‘রানমু কই? থাহি তো রাস্তায়। খাইতেই বেবাক টাহা চইল্যা যায়।’ তিনি পঙ্গু স্বামীসহ এখানে থাকেন। অসুখ হলে ফুটপাতে যাঁরা ওষুধ বিক্রি করেন, সেখান থেকে ওষুধ কিনে খান। মাঝেমধ্যে পুলিশ তাঁদের হয়রানি করে। তবে কোনো চাঁদা দিতে হয় না।

কেউ কেউ আবার কারওয়ান বাজার, বেগুনবাড়ি ও তেজগাঁও রেললাইন বস্তির বাসিন্দা। এঁরা রাত ১০টার দিকে আসেন, সকাল সাতটা-আটটায় চলে যান।

এ কাজে হাঙ্গামা আর ভোগান্তি কম না। রাতের ঘুম নষ্ট। কয়েকজন নারী বললেন, অনেক পুরুষ গায়ে হাত দেয়, বাজে মন্তব্য বা অশ্লীল ইঙ্গিত করে। সানোরা বেগম বলেন, ‘বাজার হইল বারো রহম মানুষের মেলা। খারাপ মানুষ সবহানেই আছে।’

দুর্ঘটনাও ঘটে। বছর দশেক আগে সবজির ট্রাকের নিচে চাপা পড়ে শেফালি বেগমের চোখের সামনেই মারা গিয়েছিলেন রাহেলা খাতুন। ঝড়-বৃষ্টি আর শীতে বড় কষ্ট হয়। ফরিদা বেগম বলেন, বর্ষায় পায়ে ঘা হয়ে যায়।

এঁদের কারও স্বামী জেলে, কেউ আরেকটি বিয়ে করে চলে গেছেন, কেউ বাচ্চা জন্মের পর থেকে নিরুদ্দেশ। এই নারীরা উপার্জন নিয়ে সন্তুষ্ট। এই টাকায় সন্তান মানুষ করছেন। তবে তাঁরা বলেন, রাতে নারীদের বাজারে কাজ করা এখনো পরিবার বা সমাজ ভালো চোখে দেখে না। কাজটা ভালোও লাগে না। কিন্তু অন্য কাজ পাবেন কই?

তাঁরা শুনেছেন, কারওয়ান বাজার এখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হবে। তবে তা নিয়ে মাথা ঘামান না তাঁরা। রিমা আক্তার যেমন বলেন, ‘আমরাও তহন চইল্যা যামু, সঙ্গী তো খালি অ্যাট্টা বস্তা!’

Save

Facebook Comments