banner

শুক্রবার, ০১ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 463 বার পঠিত

 

ইতিকাফ : কেন করবেন, কীভাবে করবেন?

নবীজি ইতিকাফকে খুব গুরুত্ব দিতেন। হজরত আয়েশা (রা.) বলেছেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রতি রমজানের শেষ দশক (মসজিদে) ইতিকাফ করতেন। এ আমল তাঁর ইন্তেকাল পর্যন্ত কায়েম ছিল।’ (বুখারি ও মুসলিম)

ইতিকাফ বলতে কী বুঝায় বা এর পরিচয় কী?
পবিত্র রমজান মাসে বিভিন্ন ইবাদত-বন্দেগির মধ্যে এতেকাফ একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। ‘ইতিকাফ’ একটি আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ অবস্থান করা, স্থির থাকা, কোনো স্থানে আটকে পড়া বা আবদ্ধ হয়ে থাকা।

ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায় রমজান মাসের শেষ দশক বা অন্য কোনো দিন জাগতিক কাজকর্ম ও পরিবার-পরিজন থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন হয়ে আল্লাহকে রাজি খুশি করার নিয়তে পুরুষের জন্য মসজিদে বা নারীদের ঘরে নামাজের নির্দিষ্ট একটি স্থানে ইবাদত করার উদ্দেশ্যে অবস্থান করা ও স্থির থাকাকে ইতিকাফ বলে।

কোরআন-হাদিসে ইতিকাফ প্রসঙ্গ
পবিত্র কোরআনের আয়াতে সূরা বাকারা : ১৮৭নং আয়াতে ইরশাদ করেছেন, আর তোমরা মসজিদে এতেকাফ কালে স্ত্রীদের সাথে মেলামেশা করো না

নবীজি ইতিকাফকে খুব গুরুত্ব দিতেন। হজরত আয়েশা (রা.) বলেছেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রতি রমজানের শেষ দশক (মসজিদে) ইতিকাফ করতেন। এ আমল তাঁর ইন্তেকাল পর্যন্ত কায়েম ছিল।’ (বুখারি ও মুসলিম)

ইতিকাফ কত প্রকার ও কি কি?
ইতেকাফ তিন প্রকার- ১. ওয়াজিব, ২. মুস্তাহাব, ৩. সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ আলাল কিফায়া। ইতিকাফ করার মানত করলে সে ইতিকাফ আদায় করা ওয়াজিব। রমজানের শেষ ১০ দিনে ইতেকাফ করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ আলাল কিফায়া। সুন্নতে মুয়াক্কাদা আলাল কিফায়া মানে হলো, একটি মহল্লা বা এলাকার সবার পক্ষে অন্তত একজন আদায় করতে হবে। না হয় পুরো এলাকাবাসীর গুনাহ হবে। আর রমজানের শেষ ১০ দিন ব্যতিরেকে যত ইতেকাফ করা হবে- তা মুস্তাহাব। কোনো ফুকাহা ইকরাম একে নফল ইতিকাফও বলেছেন।

ইতিকাফ আদায় করা বা সহিহ হওয়ার জন্য কী কী শর্ত রয়েছে?
ইতিকাফ আদায় করা বা সহিহ হওয়ার জন্য চারটি শর্ত রয়েছে: ১. পুরুষের মসজিদে এবং নারীদের জন্য ঘরে অবস্থান করা। ২. ইতিকাফের নিয়ত করা ৩. বড় না পাক থেকে পাবিত্রতা অর্জন করা। এবং ৪. রোজা রাখা

ইসলামের দৃষ্টিতে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট ইতেকাফ কী?
মসজিদুল হারামে আদায়কৃত ইতিকাফ ইসলামের দৃষ্টিতে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট ইতেকাফ। তারপর মসজিদে নববীর ইতিকাফ এবং তারপর বায়তুল মুকাদ্দাস। তারপর উৎকৃষ্ট ইতেকাফ হলো- কোনো জামে মসজিদে ইতিকাফ করা যেখানে রীতিমতো জামায়াতে নামায হয়। এরপর মহল্লার মসজিদে।

একজন মুসলিম কেন ইতিকাফ করবে?
১- একটি ইসলামের বিধান মান্য করার মাধ্যমে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক দৃঢ় করার উদ্দেশ্যে । ২-মানবীয় পাশবিক প্রবণতা এবং অহেতুক কাজ থেকে দুরে থাকার চর্চা। ৩- শবে কদর তালাশ করার উদ্দেশ্যে।

মহানবী (সা.) বলেন, আমি লাইলাতুল কদরের সৌভাগ্য ও মহিমা অনুসন্ধানে প্রথম দশদিন ও মাঝের দশদিন এতেকাফ করেছি অবশেষে আমার কাছে একজন ফেরেশতা এসে বলেছেন, লাইলাতুল কদর শেষ দশকে। কাজেই তোমাদের মধ্যে যারা লাইলাতুল কদরকে অর্জন করতে চায়, তারা যেন শেষ দশকে এতেকাফ করে।

৪- মসজিদে অবস্থানের অভ্যাস গড়ে তোলা। ৫- দুনিয়ামুখি মানসিকতা ত্যাগ ও বিলাসিতা থেকে দুরে থাকা। ৬. এছাড়া হাদিসে ইতিকাফ করার ফজিলতের কথা উল্লেখ রয়েছে, এইসব ফজিলত অর্জনের উদ্দেশ্যও ইতিকাফ করা যেতে পারে। যেমন এতেকাফের ফজিলত সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি রোজার শেষ ১০ দিন এতেকাফ করবে, সে ব্যক্তি দু’টি হজ ও দুটি ওমরার সমপরিমাণ সওয়াব পাবে। (বুখারি ও মুসলিম)

হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে অপর একটি হাদিস বর্ণিত, রাসূলে পাক (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশে এতেকাফ করবে, আল্লাহ তায়ালা তার এবং জাহান্নামের আগুনের মধ্যে তিনটি পরিখার দূরত্ব সৃষ্টি করবেন। প্রত্যেক পরিখার প্রশস্ততা দুই দিগন্তের চেয়েও বেশি। (বায়হাকি)।

ইতিকাফের সময় কি কি কাজ করা যাবে এবং কি কি কাজ করা যাবে না
এক. এতেকাফের মধ্যে যেসব কাজ করা জায়েজ বা করা যাবে
১. পেশাব পায়খানার জন্যে বাইরে যাওয়া জায়েয। মনে রাখতে হবে এসব প্রয়োজন এমন স্থানে পূরণ করতে হবে যা মসজিদের নিকটে হয়।
২. ফরয গোসলের জন্যেও এতেকাফের স্থান থেকে বাইরে যাওয়া জায়েয। তবে মসজিদেই গোসল করার ব্যবস্থা থাকলে সেখানেই গোসল করতে হবে।
৩. খানা খাওয়ার জন্য মসজিদের বাইরে যাওয়া যায় যদি খানা নিয়ে আসর কোনো লোক না থাকে। খানা আনার লোক থাকলে মসজিদে খাওয়াই জরুরী।
৪. জুমা ও ঈদের নামাযের জন্যেও বাইরে যাওয়া জায়েয।
৫. যদি কোথাও আগুন লাগে, অথবা কেউ পানিতে পড়ে ডুবে যাচ্ছে অথবা কেউ কাউকে মেরে ফেলছে অথবা মসজিদ পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা হয় তাহলে এসব অবস্থায় এতেকাফের স্থান থেকে বাইরে যাওয়া শুধু জায়েযই নয় বরঞ্চ জরুরী।
৬. জুমার নামায আদায়ের জন্য বা কোনো জরুরত পুরণ করার জন্যে বের হলো এবং এ সময়ে সে কোনো রোগীর সেবা করলো অথবা জানাযায় শরীক হলো তাহলে তাতে কোনো দোষ হবে না।
৭. যে কোনো প্রাকৃতিক অথবা শরীয়াতের প্রয়োজনে মসজিদ থেকে বের হওয়া জায়েয।
৮. যদি কেনাবেচার কোনো লোক না থাকে এবং বাড়ীতে খাবার কিছু না থাকে তাহলে প্রয়োজনমত কেনাবেচা করা এতেকাফকারীর জায়েয।
৯. আযান দেয়ার জন্যে মসজিদের বাইরে যাওয়া জায়েয।
১০. এতেকাফ অবস্থায় কাউকে দীন সম্পর্কে পরামর্শ অথবা চিকিৎসা সংক্রান্ত পরামর্শ দেয়া জায়েয। বিয়ে করা, ঘুমানো এবং আরাম করা জায়েয।

দুই. এতেকাফে যেসব কাজ করা না জায়েজ বা অবৈধ
১. এতেকাফ অবস্থায় যৌনক্রিয়া করা এবং স্ত্রীকে আলিঙ্গন করা হলে এতেকাফ নষ্ট হবে।
২. এতেকাফ অবস্থায় কোনো দুনিয়ার কাজে লিপ্ত হওয়া মাকরূহ তাহরিমী। বাধ্য হয়ে করলে জায়েয হবে।
৩. এতেকাফ অবস্থায় একেবারে চুপচাপ বসে থাকা মাকরূহ তাহরিমী। যিকির ফিকির, তেলাওয়াত প্রভৃতিতে লিপ্ত থাকা উচিত।
৪. মসজিদে বেচাকেনা করা। লড়াই-ঝগড়া করা, গীবত করা অথবা কোনো প্রকার বেহুদা কথা বরা মাকরূহ।
৫. কোনো প্রাকৃতিক ও শরয়ী প্রয়োজন ব্যতিরেকে মসজিদের বাইরে যাওয়া অথবা প্রাকৃতিক ও শরয়ী প্রয়োজনে বাইরে গিয়ে সেখানেই থেকে যাওয়া জায়েয নয়। তাতে এতেকাফ নষ্ট হয়ে যাবে।

কী কী কারণে ই‘তিকাফ ভঙ্গ হয়ে যায়?
১. স্বেচ্ছায় বিনা প্রয়োজনে মাসজিদ থেকে বের হলে
২. কোন শির্ক বা কুফরী কাজ করলে।
৩. পাগল বা বেঁহুশ হয়ে গেলে।
৪. নারীদের হায়েয-নিফাস শুরু হয়ে গেলে।
৫. স্ত্রীসহবাস বা যে কোন প্রকার যৌন সম্ভোগ করলে।

রাসুল [সা.] কীভাবে ইতেকাফ করতেন?
১. আয়েশা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মৃত্যু-পূর্ব পর্যন্ত রমজানের শেষ দশ দিনে এতেকাফ পালন করেছেন। [বোখারি : ২০২৬।]

২. এতেকাফরত অবস্থাতেও রাসুল পাক-পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার প্রতি গুরুত্বারোপ করতেন।

৩. এতেকাফকালীন রাসুল কোন অসুস্থ ব্যক্তির দর্শনে যেতেন না, অংশ নিতেন না কোন জানাজায়, বর্জন করতেন স্ত্রী সংস্পর্শ বা সহবাস। আয়েশা রা. বলেন : এতেকাফকারীর সুন্নত হচ্ছে অসুস্থের দর্শনে গমন না করা, জানাজায় অংশ না নেয়া, নারী সংসর্গ ও সহবাস বর্জন করা এবং অত্যবশ্যকীয় কোন প্রয়োজন ব্যতীত এতেকাফ হতে বের না হওয়া। [আবু দাউদ : ২৪৭৩।]

৪. রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যবশ্যকীয় কোন কারণ ব্যতীত এতেকাফগাহ হতে বের হতেন না। আয়েশা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসুল এতেকাফরত অবস্থায় কোন কারণ ব্যতীত গৃহে প্রবেশ করতেন না। [বোখারি : ২০২৯।]

৫. এতেকাফরত অবস্থায় রাসুলের স্ত্রী-গণ তার সাথে সাক্ষাৎ করতেন এবং কথোপকথন করতেন তার সাথে। সাফিয়া রা. বলেন : রাসুল এতেকাফরত অবস্থায় আমি তার সাথে সাক্ষাতের জন্য এলাম, তার সাথে আলাপ করে অত:পর চলে এলাম…। [বোখারি : ৩০৩৯।] প্রমাণ করে, এতেকাফরত অবস্থাতেও রাসুল স্ত্রী-গণের সংবাদ নিয়েছেন। এতেকাফের ফলে যে মূর্খরা তাদের পরিবার-পরিজনের কথা ভুলে যায়, তারা এ থেকে শিক্ষা নিতে পারে।

মাওলানা মিরাজ রহমান

Facebook Comments