বাংলাদেশের নারী উদ্যোক্তা সংখ্যা এখনো বেশ কম। এর বড় কারণ সামাজিক ও পারিবারিক দিক থেকে বিভিন্ন প্রতিকূলতা। বাংলাদেশ আর্থ-সামাজিক অবস্থা এখনো নারী উদ্যোক্তাবান্ধব হয়ে ওঠেনি। তবু নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে অনেক নারী উদ্যোক্তা হয়েছেন। তেমনই একজন ফারজানা হাসিন। গতানুগতিক চাকরি ছেড়ে নারায়ণগঞ্জের এই তরুণ উদ্যোক্তা গড়ে তুলেছেন তৈরি পোশাক ও অনলাইনে পণ্য বিক্রয়ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান সাফান ট্রেডস।
ফারজানা হাসিনের উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প বেশি পুরনো নয়। ২০০৮ সালে রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ফার্মেসিতে অনার্স সম্পন্ন করেন। ২০০৯ সালে অপর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্পন্ন করেনএকই বিষয়ে মাস্টার্স। ২০০৮ সাল থেকে ২০১৪ পর্যন্ত বিভিন্ন ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন তিনি। প্রতিদিন ছিল ৮টা-৫টা গৎবাঁধা কাজ। একঘেয়ে এই কাজে নিজের মেধার কোনো মূল্যায়ন হয়নি বলে মনে করেন ফারজানা। চাকরির শুরু থেকেই তিনি নিজের একটি প্রতিষ্ঠান দাঁড় করানোর স্বপ্ন দেখতেন।
নিজের প্রতিষ্ঠানের ইচ্ছার কথা পরিবারকে জানানো হলে সমর্থনের পরিবর্তে বিরোধিতাই পান ফারজানা হাসিন। এখানেই দমে যাননি তিনি। নিজের সিদ্ধান্তে অটল থেকেছেন। অবশ্য পরিবারে অসহযোগিতা পেলেও মায়ের সমর্থন পেয়েছেন তিনি।
চাকরি করার সময়ই উদ্যোক্তা হওয়ার পরিকল্পনা ছিল ফারজানা হাসিনের। তাই ওই সময় থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন খাত সম্পর্কে তিনি জানার চেষ্টা করেন। তিনি বুঝতে পারেন তৈরি পোশাকের শিল্পের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে বিশ্বের যেকোনো দেশের চেয়ে এগিয়ে। তাই এই খাতকেই নিজের উদ্যোগের জন্য বেছে নেন ফারাজানা। উদ্যোগ শুরুর আগেই এই পেশায় জড়িত কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে পরামর্শ করেন। উদ্যোগের জন্য প্রয়োজন ছিল পণ্যের ভোক্তা ও সরবরাহকারী। বাণিজ্য উন্নয়ন বিষয়ে চাকরির দক্ষতা তাঁর উদ্যোগের যথার্থতা নিরুপণে কাজে দেয়। তৈরি পোশাকের বিপণন নিয়ে উদ্যোগের একটি পরিকল্পনা দাঁড় করান ফারজানা হাসিন। তৈরি করেন ভোক্তা ও সরবরাহকারীদের তালিকা।
মোটামুটি একটা পরিকল্পনা নিয়ে ২০১৪ সালের মাঝামাঝি উদ্যোগের শুরু করেন ফারাজানা হাসিন। নিজের কোম্পানির নাম সাফান ট্রেডস ঠিক করে ফেসবুকে প্রোফাইল করেন। সরবরাহকারী ও ভোক্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন তাঁরা। অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই তিনি অনেক সরবরাহকারী ও ভোক্তা জোগাড় করেন। বাজারে চাহিদার ভিত্তিতে নির্দিষ্ট পণ্য কেনার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। ২০১৪ সালের এপ্রিলের শেষ দিকে ফারজানা পণ্য কেনা ও বিক্রয় শুরু করেন । জুন-জুলাই (২০১৪) সালে একজন কর্মচারী নিয়োগ করেন। ধীরে ধীরে কর্মীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় সাতজনে। এরই মধ্যে মালয়েশিয়া, দুবাই, সৌদি আরব, ঘানা, কাতার, ব্রাজিলসহ কয়েকটি দেশে সীমিত আকারে পণ্য রপ্তানি করে সাফান ট্রেডস।
ফারজানা হাসিন উদ্যোগের শুরুতে পূঁজি ছিল মাত্র এক লাখ টাকা। তৈরি পোশাকের উদ্যোগের জন্য এই পূঁজি যে অত্যন্ত কম তা অল্প কদিনেই বুঝতে পারেন তিনি। তবে এ কারণে ফারজানার উদ্যোগ থেমে থাকেনি। আর্থিক সংকটের মধ্যে তিনি সাফান ট্রেডের কাজ চালিয়ে গেছেন।
শুরুর দিকে ফারজানা হাসিনের সাফান ট্রেডস যোগাযোগের মধ্যেমে গার্মেন্টের বিশেষ পণ্যগুলো সংগ্রহ করে সুবিধাজনক মূল্যে দেশ-বিদেশের ভোক্তার কাছে পৌঁছে দিত। বর্তমানে সাফান ট্রেডের ছায়ায় আরো দুটি উদ্যোগ চালানো হয়। একটি হলো ফেসবুক-ভিত্তিক ই-কমার্স পেজ ‘ওয়ান শপ বিডি’ অপরটি হলো নিজস্ব পণ্য ‘ববস গিয়ার’। এ ছাড়া অনলাইন-ভিত্তিক আরো বেশ কিছু ব্যবসায়িক প্রকল্প নিয়ে কাজ করছেন ফারজানা হাসিন।
চলতি বছরের শুরুতে নারায়ণগঞ্জ থেকে উত্তরায় চলে আসেন ফারজানা হাসিন ও তাঁর পরিবার। এ কারণে আবার নতুন উদ্যোগে কাজকর্ম শুরু করেছেন তিনি। একই সঙ্গে নতুন করে কর্মী নিয়োগ করা হয়।
সাফান ট্রেডের স্বীকৃতিস্বরূপ ১০ এপ্রিল রাজধানীর বাংলামোটরে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মিলনায়তনে ‘চাকরি খুঁজব না চাকরি দেব’ গ্রুপের পক্ষ থেকে ফারজানা হাসিনকে নবীন উদ্যোক্তা স্মারক-২০১৪ দেওয়া হয়।
ফারজানা হাসিনের পরবর্তী লক্ষ্য হলো নিজস্ব পণ্য ‘ববস গিয়ার’কে প্রতিষ্ঠিত করা। এই লক্ষ্যে তিনি কাজ করে চলেছেন। এ ছাড়া ওষুধ শিল্প নিয়েও কাজ করতে চান ফারজানা।
ফারজানা হাসিনের মতে, তাঁর মতো ছোট উদ্যোক্তারা নিজেদের সামান্য বিনিয়োগে একটা নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছেন। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পর্যাপ্ত সাহায্যের অভাবে অনেকে বেশিদূর যেতে পারছেন না। সরকারি বা বেসরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা থাকলে আরো অনেক তরুণ উদ্যোক্তারা উৎসাহী হবেন এবং আরো অনেক উদ্যোক্তা তৈরি হবে।