banner

বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 358 বার পঠিত

হার না মানা শাহনাজ এর গল্প

52a8b72344d8a-8

রাশিদা খাতুনঃ আপনার নামটা বদলে কী লেখা যায় বলেন তো?
প্রশ্ন শুনেই একটু থমকে যান তিনি। বলেন, ‘আমার গল্প আরেকজনের নামে কেন লিখবেন? আমি কি আপনাদের থেকে ভিন্ন কেউ। কেন পরিচয় লুকাতে হবে। আমার চেহারায় কি মানুষের ছাপ নেই?’ কথাগুলো বলছিলেন শাহনাজ বেগম। রাজধানীর মোহাম্মদপুরে অবস্থিত বেসরকারি সংস্থা দুর্জয় নারী সংঘের প্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক শাহনাজ বেগম। জীবনে বহু ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে আজকের এ অবস্থানে এসেছেন তিনি।
শাহনাজের জীবনকাহিনি শুনতে ১৮ নভেম্বর যাই তাঁর শ্যামলীর বাসায়। শাহনাজ জানান, চার ভাই ও দুই বোন নিয়ে আগে একটা সুখের সংসারই ছিল তাঁদের। থাকতেন মিরপুরে। বাবা ছিলেন মাছের ব্যবসায়ী। মা মারা গেলেন ১৯৭১ সালের ২৫ ডিসেম্বর। তখন শাহনাজের বয়স ১২ বছর। ঠিক ৪০ দিন পর বাবা আরেকটি বিয়ে করেন। সৎমা এসে শাহনাজদের নির্যাতন করা শুরু করেন। মা-বাবা ভাত খেলেও তাঁদের দেওয়া হতো শাক আর আটার ঘন্ট। এরপর বাবা এক বোনকে যেন কোথায় দিয়ে দেন। তাঁর খোঁজ আর কোনো দিন পাওয়া যায়নি। সংসারে সৎমায়ের নির্যাতন থেকে বাঁচার জন্য তিনি দূর সম্পর্কের এক মামার কাছে কাজ চেয়েছিলেন। মামা যে কাজের ব্যবস্থা করে দিলেন সেটা ছিল যৌনকর্ম। ১৯৭৩ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তাঁকে এ পেশায় থাকতে হয়েছে। যার অধীনে তাঁকে কাজ করতে হতো তিনিই নিয়ে যেতেন শাহনাজের অর্জিত সব টাকা। বিনিময়ে থাকা-খাওয়া মিলত বিনা পয়সায়। সে সময়ের স্মৃতি উল্লেখ করে শাহনাজ বলেন, বয়স কম হওয়ায় তিনি ভালোভাবে খদ্দেরের চাহিদা মেটাতে পারতেন না। এর ফলে নানা ধরনের শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে তাঁকে। বস্তিবাসী এবং ভবঘুরেদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য ১৯৯৬ সালে মেরী স্টোপস ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ শাহনাজকে এলাকাভিত্তিক মাঠকর্মী হিসেবে নিয়োগ দেয়। শাহনাজ নিয়োগ পান মেরী স্টোপস ক্লিনিকের মহাখালী শাখায়। সে সূত্রে তিনি মহাখালী, শ্যামলী ও মোহাম্মদপুর বস্তির নারীদের পাশাপাশি, যৌনকর্মীদের ক্লিনিকে নিয়ে আসতেন স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের জন্য। পূর্বপরিচিত একজন তাঁকে ঘর করার স্বপ্ন দেখালেন। শাহনাজ বিয়ে করলেন তাঁকে। ২০০১ সালের জন্ম নিল এক পুত্রসন্তান। সে বর্তমানে ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ছে। তবে শাহনাজ বুঝতেন এ ঘরে টিকে থাকা কঠিন হবে। হলোও তা-ই। স্বামীর নিষেধ সত্ত্বেও শাহনাজ দিন-রাত কাজের পিছে ছুুটেছেন। শাহনাজের স্বামী তাঁর ওপর আস্থা রাখতে পারেননি। তিনি আবার বিয়ে করেছেন। ফিরে গেছেন নিজ গ্রামে। এ সময়ের মধ্যে কেয়ার বাংলাদেশ ও মেরী স্টোপস ক্লিনিকের যৌথ প্রজেক্ট ‘শক্তিতে’ কাজ করেন শাহনাজ। এইচআইভি প্রতিরোধসহ যৌন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নারীর নিজস্ব উদ্যোগ কী হওয়া উচিত বুঝতে পারেন শাহনাজ। শাহনাজের কর্মদক্ষতায় সন্তুষ্ট হয়ে ১৯৯৭ সালে কেয়ার বাংলাদেশ তাঁকে ভারতের যৌনপল্লি ‘সোনাগাছি’ পরিদর্শনে পাঠায়। ওই যৌনপল্লির কর্মীরা গড়ে তুলেছেন দুর্বার মহিলা সংগঠন নামে একটি বেসরকারি সংস্থা। নিজেদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য। শাহনাজের মনে হলো এমন একটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশেও দরকার। ফিরে এসে কেয়ার বাংলাদেশসহ বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার পরামর্শ ও সহযোগিতায় ঢাকার শ্যামলীতে গড়ে তুললেন ‘দুর্জয় নারী সংঘ’। এই সংঘ যৌনকর্মীদের স্বার্থে কাজ করছে। স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি সেলাই প্রশিক্ষণ, মোমবাতি তৈরি, ব্যাগ তৈরি শেখাচ্ছেন তাঁদের। যাঁদের অনেকেই স্বাবলম্বী হয়ে ফিরে গেছেন ঘরে। প্রতিবছর ৫০ জন বা তাঁরও বেশি যৌনকর্মীর লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন হয়ে যায়। তথ্যপ্রমাণ জোগাড় করতে পারলে আইনি লড়াই করেন শাহনাজ। শাহনাজের স্বপ্ন, যেন কোনো মেয়ে ক্ষুধার জ্বালা মেটাতে এসে যৌনকর্মী না হয়। এইচআইভি/ এইডস প্রতিরোধে বিভিন্ন কার্যক্রমের জন্য কানাডা থেকে দুর্জয় নারী সংঘ পায় ‘রেড রিবন’ পুরস্কার। ইউক্রেন, থাইল্যান্ড
, জিম্বাবুয়ে ও জাম্বিয়ার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের এই সংস্থা ‘রেড রিবন’ পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয় ২০০৬ সালে।

শাহনাজের পুঁথিগত বিদ্যা নেই। কিন্তু জীবনের কাছে শিখে নিয়েছেন হার না মানার শিক্ষা।

Facebook Comments