খন্দকার মর্জিনা সাঈদ : বাংলা ১২৯৮ সনের কথা। তখন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ছোটগল্প দেনা পাওনায় অসহায় নারী নিরূপমার কথা লিখেছেন। যার বিয়েতে দশ হাজার টাকা পণের পুরোটা দিতে না পারায় শ্বশুরবাড়িতে নিত্যনির্যাতন। একবারের জন্যও বাবার বাড়িতে না যেতে দেয়া। শ্বশুরগৃহে মেয়ের সামনে বাবার অপমান। নিরূপমার নিরুপায় হয়ে বাবাকে উদ্দেশ করে বলা, ‘বাবা তুমি যদি আর এক পয়সা আমার শ্বশুরকে দাও তা হলে আর তোমার মেয়েকে দেখতে পাবে না। এই তোমার গা ছুঁয়ে বললুম।’ অবশেষে শোক, দুঃখ, অপমান, অভিমান সঙ্গী করে নিরূপমার একপ্রকার স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে বরণ। মৃত্যুর পরে, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট স্বামীর চিঠি, স্ত্রীকে অবিলম্বে পাঠানের অনুরোধ। প্রতি উত্তরে শ্বশুর রায়বাহাদুর মহিসী ছেলেকে লিখেছেন, ‘বাবা তোমার জন্য আর একটি মেয়ে সম্বন্ধ করিয়াছি। অতএব অবিলম্বে ছুটি লইয়া এখানে আসিবে। এবার বিশ হাজার টাকা পণ এবং হাতে হাতে আদায়।’
১২৯৮ সাল সেই কবেই পার হয়েছে। এতটা সময় পার করেও এই ভারতেরই হরিয়াণ রাজ্যে নারী বিক্রির রেওয়াজ চলছে। বয়স ও শারীরিক গঠনের বিচারে ৫ থেকে ৩০ হাজার রুপি পর্যন্ত দামে এদের বিক্রি করা হয়। এমন কি, লোকসভা নির্বাচন জনসম্মুখে নারীপ্রার্থীরা শ্লীলতাহানির শিকার হচ্ছেন। আর আপনার আমার মেয়েরা! যাদের আমরা নিরাপত্তার বেষ্টনীতে জড়িয়ে তিলে তিলে বড় করছি। তথাকথিত শিক্ষিত সুপাত্র দেখে বিয়ে দিয়েছি। তবু তারা কতটা নিরাপদ বাবার গৃহ ছেড়ে স্বামীর গৃহে! আবেগতাড়িত হয়ে কথাগুলো বলছিলেন একজন মা ব্যারিস্টার মনোয়ারা বেগম। তিনি বলেন, একমাত্র মেয়ে হওয়ায় ওর সংসার পর্যন্ত নিজ হাতে সাজিয়ে দিয়েছি। শ্বশুরবাড়ির সব সমস্যার ব্যাপারে সোচ্চার থেকেছি। বেকার সদস্যদের চাকরির ব্যবস্থা করেছি।
প্রথম প্রথম পুত্রবধূকে কেন্দ্র করে এত সব সুবিধা পেয়ে ওরা কৃতজ্ঞ ছিল। পুত্রবধূর প্রশংসা ছিল মুখে মুখে। আমার মেয়ের প্রতিও ছিল আন্তরিক। কিন্তু সমস্যা দেখা দিলো এক বছর পার হতেই। যখন তাদের ছেলের আয় রোজগার, সম্মান ক্ষমতা উভয়ই বাড়ল। সাথে বাড়ল পুত্রবধূর পরিবারের কাছে চাহিদার লিস্টও। নিজস্ব গাড়ি, ফ্যাট, মেয়ের যাবতীয় খরচের বিষয়টি তো এর মধ্যে ছিলই। যা অভিভাবক হিসেবে সবসময়ের জন্য আমরা পূর্ণ করতে ব্যর্থ হওয়ায় এবং স্বামীর কাছে স্ত্রী ভরণ-পোষণের অধিকার চাওয়া মাত্রই বাধে বিপত্তি। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ছোটখাটো বিষয়কে প্রাধান্য করে প্রতিদিনই বাধে সঙ্ঘাত। সে সঙ্ঘাত থেকে আমার মেয়ে আত্মরক্ষা করতে গেলে বিষয়টি অন্য ধারায় প্রবাহিত হয়। জনে জনে প্রচার পায়, পুত্রবধূ স্বামী, শাশুড়ি দু’জনকেই মারধর করেছে। ওকে সমাজে দাঁড় করায়, জেদি, স্বেচ্ছাচারী, প্রতিহিংসাপরায়ণ একজন নারী হিসেবে। আইনের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ওর স্বামী জনসমক্ষে স্ত্রীর মারের ক্ষতচিহ্ন দেখাতে পারলেও আমার মেয়ে নারী বলেই পারেনি তার শরীরের স্পর্শকাতর স্থানগুলো খুলে দেখাতে। পারেনি প্রমাণহীন মানসিক নির্যাতনের কথা বলতে। যে কারণে শাশুড়িকে মারধরের বিষয়টি প্রাধান্য পায়। আইনি প্রক্রিয়ায় পাত্রপক্ষের বিয়ে ভাঙা সহজ হয়। যে বিয়েটা কি-না কেবলই পদমর্যাদা বৃদ্ধিতে সহায়ক ছিল। ছিল একধরনের মুখোশের আড়ালে সন্ধিপত্র মাত্র। আর এমন ভুক্তভোগী আমি এবং আমার মতো অনেক পরিবারই আছে। যারা অতি সুবিধাজনক অবস্থানে অবস্থান করেও সতর্কতা অবলম্বন করেও চোরাবালির মতো সম্পর্কের ফাঁদে জড়িয়ে যাচ্ছেন। আপাতত বদনাম, কষ্ট কুড়াচ্ছেন বলেও জানান ব্যারিস্টার মনোয়ারা বেগম।
কথাসাহিত্যিক আয়শা ইসলাম বলেন, আমার মেয়ে শায়লাকে ওর চেয়ে ১০-১২ বছরের বড় এক প্রভাবশালী পরিবারে ছেলের সাথে বিয়ে দেই। পাত্রপক্ষের প্রভাব প্রতিপত্তি দেখে প্রথমে ও মেনে নিলেও পরে শায়লা জানতে পারে ওর স্বামীর অন্য নারীর সাথে অবৈধ সম্পর্ক। এ কারণে প্রতিনিয়তই সে তাকে শারীরিক-মানসিকভাবে এড়িয়ে চলতে চাইছে। নীরবে নিখুঁতভাবে করছে অবহেলা। তখনই শায়লা গভীর অভিমানে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। যেন একটি বাঁশের কঞ্চি জড়িয়ে শিমলতার বেঁচে থাকার মতোই তার বেঁচে থাকা। নেই স্বামীর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ-অনুযোগও। এবং বিষয়টি যে একধরনের গুপ্ত নির্যাতন তা আমাদের সবারই জানা। জানা থাকা সত্ত্বেও আমরা অভিভাবক হয়েও কিছু করতে পারছি না। আমার যে আরো তিনটি মেয়ে আছে। বড় বোনের ঘর ভাঙার অপবাদ যদি এদেরকে প্রভাবিত করে। সমাজ সংসারের মানুষেরা যদি এই নিরপরাধীদের বহুগামী, ধৈর্যহীনতার পরিচয়ে পরিচিত করে। তাই সব কিছু ভেবে শায়লাকে সর্বসয়া হয়ে দাম্পত্য জীবনে টিকে থাকার লড়াই করে যেতে হচ্ছে। আর এ রকম অনেক কারণ মেনে নিয়েই হয়তো, শায়লার মতো অগণিতদের আত্মত্যাগের বিনিময়েই তৃতীয় বিশ্বের অন্যতম এই দেশটি দিনকে দিন অগ্রগতির পথে এগোচ্ছে।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ সুমাইয়া আজাদ। তিনি তার মেয়ে মিতালি প্রসঙ্গে বললেন এ