banner

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ইং, ,

Daily Archives: April 15, 2024

 

পুরানো দিনের গল্প বলি

ডা. ফাতিমা খান

আমার বড় ছেলের বয়স তখন দুই এর কিছু বেশী। সারাদিন বুলেটের মত কথার গুলি ছোড়ে। কথা শোনার চেয়ে বলে বেশী। সব ব্যাপারে তার কৌতুহল তখন তুঙ্গে। আমি সকালে কলেজে যাই, দুপুরে আসি। বিকালে হাসপাতালে প্র‍্যাক্টিস করি, রাতে ফিরি। রোগী আর রোগবিদ্যা নিয়ে তখন আমার সারাবেলা কাটে।

ছেলেটা বাসায় থাকত কাজের মেয়েটার কাছে, ওর কথাবার্তা তখন ছেলে চুম্বকের মত আত্নস্থ করছিল। (কাজের মেয়েটা কথায় কথায় ইংলিশ ঝাড়ত, মাঝে মাঝেই জিন্স গেঞ্জী কিনে দেয়ার বায়না করত, ছাদে গিয়ে নাকি লুকিয়ে বিড়িতেও দু- এক টান মারত। বাকী কাহিনী আরেকদিন বলব ) আমি অফিস যাওয়ার সময় ছেলেকে যতই বলতাম “আব্বু আল্লাহ হাফেজ”, সে খুব ভাব নিয়ে বলত ” সি ইউ মাম্মি।”
অনেক চেষ্টা করেও যখন ” মাম্মী” র বদলে “আম্মু ” শিখাতে আর ‘সি ইউ’ ছাড়াতে পারলাম না, হাল ছেড়ে দিলাম। ওর বাবা যখন আমার সাথে বিরক্ত মুখ করে বলত ” ছেলেটা আমাকে ‘বাবা’ ডাকে ভাল লাগে না, ‘আব্বা ‘ শিখিও তো “, তখন চুপ করে ভাবতাম, আমি কাকে বলব যে আমাকে ‘আম্মু ‘ বলা শেখাতে! বুঝতাম ছেলেকে সব শেখানোর দায়িত্ব টা মায়েরই বটে! ছেলে আমার ভীষণ জেদী ছিল। শিখালেই শিখবে বা বললেই মেনে নেবে এমনটা না। চাকুরী দুইটাও করতাম অনিচ্ছায়, প্রয়োজনের তাগিদে।

ছেলের বয়স যখন তিন বছর, চলে আসলাম বিদেশ। ততদিনে আমার ছেলে অনেক কথাই শিখে ফেলেছে। বারান্দার গ্রিল ধরে দাড়ালে গার্মেন্টস কর্মীরা কেমনে ঝগড়া করছে, বা রিক্সাভাইকে সদা ক্ষিপ্ত রাস্তার সার্জেন্টগুলো কিরকম করে গালি দিচ্ছে, সব তার ঠোটস্থ!

এখানে আমার একটা ব্যক্তিগত মতামত বলি। আমি কোন জাতি, ভাষা বা কোন কাজ কে ছোট মনে করতাম না আর এখনো করি না, যতক্ষণ না তা আমার ধর্মীয় আদর্শের বা নৈতিকতার পরিপন্থী হয়। আমার ছেলেদেরকেও এই আদর্শ কে সামনে রেখেই গড়ে তুলছি। ভাষাগত ব্যাপারে বা সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও তাই। বিজাতীয় বা বিধর্মীয় সংস্কৃতি আমি পছন্দ করিনা। অকারণ বা অযৌক্তিক প্রথাগুলোও পছন্দ না। বছরে একদিন মাতৃভাষা দিবস পালন করি কিন্তু সারাবছর টডর মডর ইংরেজী বলার চেষ্টা করি আর বাচ্চাদেরও তাই শেখাই, এতে লাভ কি হল? ভাষার জন্য যারা সংগ্রাম করেছেন, জীবন দিয়েছেন তারা কি শুধু বছরে একটা দিনই সম্মানিত হবেন? জন্মের পর থেকে সন্তানকে ‘মা’ না শিখিয়ে ‘মাম্মা’ শেখাই আর এদিকে বছরে একদিন ভাষা শহীদদের সমাধিতে ফুল দেই…এটা কেমন কথা ?

ছুটিতে দেশে গেলে আমার খুব আজব লাগে যখন দেখি ছোট ছোট বাচ্চাগুলোর সাথে বাবা মা (হোক শিক্ষিত বা মুর্খ) বাংলা-ইংরেজী শব্দ মিলিয়ে কথা বলে। একদিন তো এক কাজের মহিলাকেও দেখলাম ছেলেটাকে একপাশে সিথি কেটে চুল আচড়ে বলছে “নাইস লাগতাসে”।
কেউ কেউ আবার সকাল বেলা ‘মর্ণিং টি’ খায়, বাচ্চাকে বলে ‘সোপ’ দিয়ে ‘শাওয়ার’ করতে, বাংলা অনুষ্ঠানে পোলাও এর বদলে ‘রাইস’ খায়, খেয়ে আবার বাচ্চাকে ‘ডার্টি হ্যান্ডটা ‘ ‘ওয়াশ’ করে আসতে বলে, সব শুনে আমার কেমন যেন আউলা লাগে। আরে বাবা, বললে ভাল করে হয় বাংলা বল, নয়ত ইংরেজী! খিচুড়ি বানানোর কি আছে!

সব দেখে আমার নিজের ছেলেদের ব্যাপারে একটা প্রশান্তি লাগে। ওরা অন্তত নিজের দেশীদের সাথে খাটি বাংলায় কথা বলে, তাও আবার কখনো বই পত্রের মত বিশুদ্ধ ভাষায়। ইংরেজীতে বাচনভঙ্গি অন্তত আমার চেয়ে ওদেরটাই ভাল! কিন্তু মানুষ ও পরিস্থিতি বুঝে কথা বলতেও তারা জানে। ‘মাম্মী’ বদলে এখন বড়জন ‘আম্মু’ বলাও শিখেছে বিদেশে এসে। দেশী গালিগালাজ গুলো মনে হয় ভুলে গেছে এতদিনে । দেশীয় সংস্কৃতিগুলো সম্পর্কে তার জ্ঞান অন্তত ওর সমবয়সী দেশী আর দশজন বাচ্চার থেকে কোন অংশে কম না।
আলহামদুলিল্লাহ!

দেশে যাওয়া হয় প্রতি বছরই । সেবার শ্বশুরবাড়ির দিকের এক আত্নীয় জিজ্ঞেস করলেন ” বিদেশে থেকেও তোমার ছেলেরা এত ভাল বাংলা পারে কেমন করে? ”
আমি কিছুই বলিনি। শুধু এক বুক গর্ব হয়েছিল নিজের ভাষার জন্য, আমার পারগতার জন্য !

কর্মরত: আল হিবা মেডিক্যাল গ্রুপ, জেদ্দা, সৌদি আরব।