banner

বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ইং, ,

Daily Archives: April 23, 2024

 

বসন্তের শুভেচ্ছা

ফাতিমা মারিয়াম


মালা গ্রামের মেয়ে। মামার পরিচয়ের সূত্রে বিয়ে হয় ঢাকায়।

মালার শ্বশুরবাড়ি আর বাবার বাড়ি একই জেলায়। তবে তার স্বামী আনিস ঢাকাতেই প্রতিষ্ঠিত।

আনিস একজন সরকারী কর্মকর্তা। বেতনের চাইতে উপরি আয়ই বেশি। অনেক অনেক টাকা হাতে আসার কারণেই হোক অথবা গ্রামের মেয়ে হঠাৎ রাজধানীতে রাজরানি হওয়ার কারণেই হোক মালা বেশ বেহিসাবি জীবন যাপন করা শুরু করে।

আনিস কখনো কিছু বলে না। কারণ বলার মত শক্ত মেরুদণ্ড তার নেই।

মালার লাগামহীন ছন্নছাড়া জীবন যাপনের ব্যাপারে কেউ কিছু বলতে বললেই আনিস বলে- আরে থাক না। এখন তো সবাই এভাবেই জীবন কাটায়। ওকে তাই কিছু বলি না।

আনিসের মা বাবা কেউ কখনো মালার ব্যাপারে কিছু বলেও আনিসের কাছে পাত্তা পায় না। সবাইকে সে বুঝাতে চায় যেভাবেই চলুক না কেন মালা মানুষ হিসেবে ভালো। তার আত্মীয়স্বজন তো বটেই এমন কি মালার আত্মীয়রাও আনিসের স্ত্রৈণ স্বভাবের জন্য আড়ালে আবডালে বিরক্তি প্রকাশ করে।

একে একে দুইটি সন্তান হয় মালা ও আনিসের। তারা দিন দিন বড় হয়। মালার বেহায়াপনা বাড়তে থাকে, বাড়ে আনিসের আয়। আয়ের পুরো টাকা বউয়ের হাতে তুলে না দেয়া পর্যন্ত মায়া আনিসকে শান্তি দেয় না।

এক পর্যায়ে স্বামী স্ত্রী দুজনেই পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ে। এরপর
জানাজানি…..
কানাকানি।

তারপরও দিন যায়। সংসারে চরম অশান্তি।

ছেলে মেয়ে বড় হয়েছে। তারা বাবা মা দুজনকেই কড়া কথা শোনায়। আবার তারা নিজেরাও যে ভালো পথে চলে তা নয়। ছেলেও এক মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। সেই মেয়ের মাকে মালা দু কথা শোনায়। আবার মেয়ের প্রেমিককে নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থার কথা বেশ কায়দা করেই জানায়। ছেলেমেয়ে কোন শাসন মানতে চায় না।

পরিবারে চরম অশান্তি চলে…চলতে থাকে।



পহেলা ফাল্গুনে মা মেয়ে দুজনেই বাসন্তী শাড়ি পরে সাজুগুজু করে ফেসবুকে ছবি দেয়। আর ক্যাপশনে লিখে ‘সবাইকে বসন্তের শুভেচ্ছা’। লাইক আর কমেন্টের বন্যায় আপাতত তাদের পরিবারের অশান্তির কথা মা মেয়ে ভুলে যায়। মাতা কন্যা উভয়ে একে অন্যের পোষ্ট চেক করে দেখতে থাকেন কার পোস্ট এ লাইক বা কমেন্ট কত এসেছে![ছোট গল্প]

 

ঘুড়ি

দ্য স্লেভ


শৈশবের এই এক ঘুড়ি নিয়ে বহু পৃষ্ঠা লেখা যায়। আমাদের এলাকায় কিছু ছোট ছোট দোকান ছিলো, যেখানে নানান রঙের ঘুড়ি বিক্রি হত। কারো কারো ঘুড়ি ছিলো বিখ্যাত, কিন্তু দাম সকলের কাছেই এক টাকা। সে সময় ১ টাকা দরের ওই ঘুড়িটা যে কতটা আকাঙ্ক্ষিত ছিলো তা ঠিক ভাবে বুঝানো যাবে না। ওটা যেন এক টাকা মূল্যের কিছু ছিলোনা। ওটা ছিলো বহু মূল্যবান সম্পদের একটি অংশ।

আমার জানামতে আমি ১ টাকা দিয়ে সম্ভবত দু একবার ঘুড়ি কিনেছি। আমি একই দোকান থেকে ৫০ পয়সা দামের ছোট সাইজের ঘুড়ি কিনতাম। এই ঘুড়ি কিনে এর পেছনে লেজ লাগাতাম। সেই লেজ হত আমার অংশ খাতার কাগজ দিয়ে তৈরী। কখনও কখনও এত লম্বা লেজ তৈরী করতাম গরম ভাত দিয়ে টিপে টিপে,যে লেজের ভারে ঘুড়ি উড়তে পারত না। আমি ভাবতাম বাতাসের দোষ। তবে সেই লম্বা লেজওয়ালা ঘুড়ি নিয়ে জোরে দৌড় দিতাম,তখন তীব্র বাতাসে খানিকটা উপরে উঠত।

আমি ঘুড়ি তেমন কিনতাম না, তবে প্রতিদিন বিকেলে নদীর ধারে, রেল লাইনের উপরে তুখোড় ঘুড়িবীদরা কাটাকাটি খেলত। সে সময় আমরা বাচ্চারা দূরে দাড়িয়ে সে খেলা দেখতাম। কি যে মজা সেটা দেখতে। তবে আসল মজা হল ঘুড়ি কাটার পর সেই কাটা ঘুড়ি ধরার জন্যে দৌড় প্রতিযোগীতা। কাটাকাটি হলেই বিশাল লম্বা সূতোসহ ঘুড়ি ধীরে ধীরে নীচে নামত। বহু উপরের সেসব ঘুড়ির পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে আমরা আরেক গ্রামে পৌছে যেতাম কখনও।

আবার কখনও কখনও নদীতে পড়ত গিয়ে। তবে ঘুড়িটাকে পাবার জন্যে জীবন উৎসর্গ করতাম। কখনও সেটা লম্বা গাছে গিয়ে বেধে থাকত। এমন ক্ষেত্রে আমাদের এলাকার মারাত্মক গেছো আমিনই ঘুড়িটা পেত। আমিন যে কোনো গাছে অনায়াসে উঠে যেত দ্রুত। মাটিতে বা আমাদের আয়ত্বে থাকা স্থানে কখনও ঘুড়ি পড়লে আমি কখনও কখনও সেটা পেতাম। তখন যে কি খুশী লাগত ! তবে কখনও কখনও একাধিক লোকে ঘুড়ি ধরতে গেলে আমরা আমরা কোনো লাঠি,কঞ্চি দিয়ে ঘুড়িতে বাড়ি দিয়ে ছিড়ে ফেলতাম, যাতে কেউ নিতে না পারে। ঘুড়ি ধরা নিয়ে অনেক হাতাহাতিও হত। তবে অনেক ঘুড়িই ধরেছি।

আমার ধরা সেসব ঘুড়ি অনেক যত্ন করে খাটের নীচে অথবা ঘরের সানসাইডের উপর রাখতাম। আমার সুন্দর সুন্দর লাটাই(নাটাই) ছিলো। আমি এক ধরনের চমৎকার লাটাই বানাতাম। পুরোনো হাওয়াই চপ্পল সুন্দর গোল করে ২টা চাকা বানাতাম। এবার বাঁশের সরু কঞ্চী সুন্দর মাপে এর ভেতর প্রবেশ করিয়ে দিতাম। চাকার মাঝ বরাবর একটা ফুটো করতাম আর সেখানে মসৃণ বাঁশের কঞ্চী অথবা সুন্দর করে বানানো বাঁশের লাঠি ঢুকিয়ে লাটাই বানাতাম। আমার হাতের কারুকাজ খুব দারুন ছিলো।

আমরা সূতোয় মাজন দিতাম। বাল্বসহ নানান কাচের জিনিস ভেঙ্গে গুড়ো করতাম হামানদিস্তায়। এটার কাপুড়ে ভরে পাউডার অংশ বের করে নিতাম। এবার গদের আঠা আর কি কি যেন একসাথে জ্বালিয়ে এর ভেতর কাচের পাউডার দিতাম। তারপর এটা সূতোয় লাগিয়ে শুকাতে দিতাম। খুব ধারালো হত সূতো। এই সূতো নিয়ে কাটাকাটি খেলতাম। তবে আমার সূতোয় মজন থাকলেও আমি কাটাকাটি খেলতে চাইতাম না। কারণ ঘুড়ির প্রতি আমার খুব মায়া ছিলো। আমি আকাশে উড়িয়েই মজা পেতাম। তবে অন্যের কেটে যাওয়া ঘুড়ির প্রতি খুব লোভ ছিলো।
আমি,সাবু,ইদু,মাসু,রফি,রমজান, উজ্জল,দোলন,সুমন আরও অনেকে আমাদের মাঠে ঘুড়ি উড়াতাম। আবার কেউ কেউ অল্প সূতোয় ঘুড়ি বেধে সারা এলাকায় দৌড়ে বেড়াত, ওটাই আনন্দ। মাঠে ঘুড়ি উড়ানোর পাশাপাশি কত যে আনন্দ করতাম ! তবে সবশেষে মাঠের পুকুরে দল বেধে গোসল করতাম ঘন্টার পর ঘন্টা, সে আনন্দের কোনো তুলনা নেই।

আমি পলিথিন দিয়ে ঘুড়ি তৈরী করতাম। এই ঘুড়ি বেশী টেকসই তাই এইটা বানাতাম। আমি ভাবতাম রঙিন কাগজে এক টাকার তৈরী ওই ঘুড়ি সহজে ছিঁড়ে যায়। যদি এমন কাগজ হত, যা কখনও ছিড়বে না, তাহলে সেটা দিয়ে ঘুড়ি বানালে খুব ভালো হত। ঘুড়ি ছিলো একটা নেশা। এর অনেক কলা কৌশল রয়েছে। ঘুড়িকে বিশেষ কায়দায় বাক খাওয়ানো যায়, এক স্থান থেকে আরেক স্থানে আনা যায়। আবার পাক খাওয়ানো যায়। কাটাকাটি খেলার সময় এসব করা হয়।

এলাকার বিখ্যাত কাটাকাটিবীদ ছিলো আজিজুল ওরফে আইজুল চা(চাচা)। এছাড়া হাফি,মফিও খুব ভালো ছিলো এই বিষয়ে। ওরা রেল লাইনের উপরে গিয়ে ঘুড়ি কাটাকাটি খেলত। আমাদের উপর পারিবারিক নিষেধাজ্ঞা ছিলো রেললাইনের ওদিকে পর্যন্ত যাওয়ার ক্ষেত্রে, তাই আমরা সর্বোচ্চ নদীর ধার পর্যন্ত যেতাম। তবে বাজারের দিকে না গেলেও পায়রাডাঙ্গা, কুটিপাড়া পর্যন্ত চলে যেতাম, তাতে তেমন সমস্যা ছিলো না। কিন্তু বাজারের দিকে যাওয়া নিষেধ ছিলো। শুনতাম আইজুল চা’র সাথে অন্যরা কাটাকাটি খেলতে ভয় পেত। তবে তার ঘুড়িও কেটে যেত অনেক সময়। অনেক সময় অঅমরা নদীতে গোসলের সময়ও ঘুড়ি ধরেছি। কখনও সূতো করে ঘুড়ি উড়তে থাকা অবস্থায় ডাঙ্গায় তুলে ফেলতাম।

এখনকার বাচ্চারা এসব সাধারণ বিষয়ে মজা পায়না। এদের চিন্তার জগত পাল্টে গেছে। এদের মজার মাত্রাও তেমন মজাদার না। আমরা খুবই সামান্য কারনে মজা করতে পারতাম। সেই ঝরঝরে সুন্দর দিনগুলো এখন নেই। ৫০ পয়সা ১ টাকা দামের ঘুড়ি আমাদেরকে যে আনন্দ দিয়েছে,তা আজ লাখ টাকায়ও পাওয়া যাবে না। সেই মন আর নেই মানুষের, কেমন যেন ফর্মালিনযুক্ত মানসিকতায় আক্রান্ত হয়ে পড়েছি। সেই সহজ সরল সোনালী দিনগুলোকে মনে পড়ে। বহু কথা,বহু স্মৃতি আছে কেবল এই এক ঘুড়ি নিয়ে!
আজ আর না।…