banner

বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ইং, ,

Daily Archives: April 23, 2024

 

রেখেছি তোমায় হৃদমাঝারে

ফাতিমা শাহীন


এয়ারপোর্ট থেকে বাসায় ফিরতে ফিরতে ঘড়ির কাঁটা রাত সাড়ে বারোটার ঘর পেরিয়েছে। বাসায় এসে বিশ্রাম নিয়ে দুটো খেতে বসেছি। ডাইনিং টেবিলে রুসাফী বললো, আম্মু , তুমি কি শিওর যে আমরা প্রপারলি কানে শুনতে পাচ্ছি ? আমি ম্লান হেসে বললাম, আমি বোধহয় এখনো ততটা শিওর নই…..।

আসলে ঢাকায় কত শব্দের ভেতরে যে আমরা ছিলাম ! প্রতিটি মুহূর্তে প্রতিটি স্থানে নানান ধরণের শব্দ। চেনা অচেনা , বোধগম্য অবোধগম্য শব্দরাজি এ ক’দিনের মধ্যে আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছিল যেন।

অন্যদিকে, নভেম্বর-জানুয়ারি মাস বাংলাদেশে ওয়াজ মাহফিলের মাস। জোহর নামাজের পর থেকেই চতুর্দিক থেকে ভেসে আসতে থাকে ওয়াজের ধ্বনি। মাঝে মাঝে কোন কোন রাতে না ঘুমিয়ে কান পেতে থাকতাম যে কোন একটি ওয়াজের প্রতি মন:সংযোগ করে শুনবো বলে, কিন্তু সে উপায় কি আর আছে ? শত মাইকে , শত কণ্ঠে হিদায়াতের কত না মহান বাণী ধ্বনিত হচ্ছে , কিন্ত কোনটাই শুনে কোন কিছু বোঝার উপায় নেই।

তবুও , বছরের পর বছরভর , নি:শব্দ ও স্তব্ধতায় মোড়া এই আমাকে কি যে নিবিড় মমতার অচ্ছেদ্য এক বাঁধনে বেঁধে রেখেছিল আমার প্রিয় ঢাকা ! ফিরে আসার দিন এয়ারপোর্টে আসার পথে আমার হৃদয়খানি সহস্র টুকরো করে ঢাকার পথে পথে আমি ছড়িয়ে রেখে এসেছি। কান পেতে তৃষ্ণার্তের মত শুনে নিয়েছি শত মসজিদ থেকে ভেসে আসা আজানের ধ্বনি , রাজপথের ব্যস্তসমস্ত মানুষের উচ্চকণ্ঠ , কারণে অকারণে বেজে ওঠা যানবাহনের হর্ন , ট্রাফিক পুলিশের হুইসেল ….।

মাঝে মাঝে অকারণেই মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়। মনের আয়নায় ভেসে ওঠে চারতলা একটি বাড়ির বারান্দা , যেখানে বাতাসে উড়ছে আম্মুর শুকোতে দেয়া শাড়ির আঁচল, আব্বুর সবুজ গামছাখানি … আমার পুরো বাংলাদেশ হয়ে ! চোখ ভিজে ওঠে অজান্তেই ….
সেই ভেজা চোখ মুছতে ওই আঁচলখানির ছোঁয়া পেতে মন কেবলি হাহাকার করে ওঠে …. কেবলি …।।

 

এক মায়াবতী, রূপসী কিশোরীর করুণ কাহিনী

অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম


আমিরুল -বর্তমানে বয়স ৩২। সে ছোটকাল থেকে অটিস্টিক ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধি। তারা এক ভাই ও এক বোন। বোন বিয়ে করে জার্মান চলে যায়। তার খালু ও মা চেয়েছিল তার ঐ বোনের সঙ্গে তার খালাতো ভাইকে বিয়ে দেবে। তার মা ঐ ছেলেকে জামাই বাবা বলে ডাকতো। কিন্তু তাদের আর্থিক অবস্হা খারাপ থাকাতে ঐ মেয়ের এক ইন্জিনিয়ারের সঙ্গে বিয়ে হয়ে যায়।

আমিরুল মানসিক প্রতিবন্ধী হলেও সে মা- বাবার একমাত্র ছেলে সন্তান হওয়াতে, তার খালু চেয়েছিল তার সঙ্গে তার এক মেয়েকে বিয়ে দেবে। ঢাকায় আমিরুলদের একতলা একটি বাড়ী আছে। গ্রামে ও প্রচুর সম্পত্তি। কিন্তু ঐ মেয়ে এরকম হাবাগোবা, কুৎসিত চেহারার, অকর্মন্য ছেলেকে বিয়ে করতে রাজি হয় না। এতে ঐ বাবার মনে আফসোস থেকে যায়। এ কারণে সে লোক তার কনিষ্ঠ কন্যাকে আমিরুলের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব করে।

এই মেয়েটির বয়স তখন ১২-১৩ বছর হবে। সে দেখতে শ্যামলা, কিন্তু খুবই সুশ্রী, মিষ্টি চেহারার, মায়াবতী মেয়ে। এ বিয়ে নিয়ে তাদের আত্মীয়দের মধ্যে মতানৈক্য হয়। তবে এ লক্ষি টাইপের, অল্প বয়সী মিষ্টি চেহারা লাজুক মেয়েটি, বাবার কথার অবাধ্য হয় না। সে রাজি হয়ে যায়।

অল্প বয়সের মেয়ে বিয়ে কি, সেক্স কি, ভবিষ্যৎ কি তেমন বুঝতো না। সবাই আশা করেছিল ছেলে মানসিক প্রতিবন্ধী হলেও, কিছু করতে বা বুঝতে না পারলে ও তাদের একটি সন্তান হলে, মেয়েটি তাকে নিয়ে কোন ভাবে জীবন কাটিয়ে দিতে পারবে।

কিন্তু সে সব দিক থেকেই অপারগ। আমিরুল বউ কি,ভালোবাসা কি,সেক্স কি, দায়িত্ব কি – কিছুই বুঝে না। বরং তাকে খাইয়ে দেওয়া, গোসল করানো থেকে শুরু করে সব কিছু এই মেয়েকে করতে হয়। নিজ মা- বাবা যা করতে হিমসিম খায়, যা করতে ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে যায়- এ মেয়ে অবলীলায় তা করে যায়। ২-৩ বছর পরেও যখন আত্মীয়রা দেখলো আমিরুল কোন সন্তান তো দিতে পারছে না,বরং তার তেমন শারিরীক সম্পর্ক করার চিন্তা, চেষ্টা, আগ্রহ, ধারনা কোনটিই নাই- তখন উভয় পক্ষের আত্মীয়রা বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেয় যে আমিরুলের বউয়ের বয়স এখনো কম আছে, সে সুন্দরী তাই এভাবে তার জীবন নষ্ট করা ঠিক হবে না।

সবাই তখন ঐ মেয়েকে আমিরুলকে ছেড়ে অন্যত্র বিয়ে করতে বলে।

কিন্তু এই ২-৩ বছরের মধ্যে মায়াবতী মেয়েটি এক মায়ার জালে জড়িয়ে যায়।সে বলে ওকে ছেড়ে যাবো চিন্তা করলেই আমার বুক ফেটে যেতো, কান্না পেতো।

ভাবলাম আরেকটি বিয়ে করলে সে স্বামী যে ভালো হবে তার গ্যারান্টি কি? এ যদি আবার কোন মেয়েকে বিয়ে করে সে মেয়ে পারলে আমি কেন পারবো না? তাছাড়া আমি তো অন্য সবদিক থেকে ভালো আছি। ভালো খাচ্ছি, ভালো পড়ছি,সবার আদর পাচ্ছি। এমনকি ও আমাকে পছন্দ করে, আমার মাথায় হাত রেখে সান্ত্বনা দেয়। আমি একে কিভাবে ছেড়ে যাবো? ও এতো অসহায়, ও আমার উপর নির্ভরশীল – আমি চলে গেলে ওর কি হবে? না পেলাম স্বামীর সোহাগ বা দৈহিক আনন্দ। না পারুক আমার জন্য কিছু করতে, হোক সে দেখতে কুৎসিত। সে তো সরল, অন্য পুরুষের মতন তার তো কোন বদ স্বভাব নেই-

আমার শুধু একটি সন্তান হলেই চলবে।

কিন্তু এরপর আমিরুলের আরো অবনতি হয়, অস্বাভাবিক আচরণ বেড়ে যায়, সারাক্ষণ হা করে থাকে, লালা জড়ে।তাকে সে লালা মুছে দিতে হয়, তার খামখেয়ালি পণা, অবাস্তব আবদার মেটাতে হয়। তার দাম্পত্য জীবন বলে কিছু নেই, সন্তান তো দূর থাক। অনেক মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ দেখানো হয়েছে। সবাই বলে এর উন্নতির কোন সম্ভাবনা নেই। মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে বলে স্যার, আপনার অনেক প্রশংসা শুনে এসেছি। আমি সেক্স চাই না,ভালোবাসা, আদর চাই না, আমাকে শুধু একটি সন্তান পাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন।

একে আমি ছাড়তে পারবো না -ছাড়ার চিন্তা করলেই কান্না আছে, বুক ফেটে যায়। ওকে সুস্হ করে আমার একটি সন্তান হওয়ার ব্যবস্থা করে দিন স্যার
এ কাহিনী কি বলে:

(১) অটিজম, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ছেলে মেয়েকে নিয়ে নিজ মা- বাবারাই যেখানে থাকে অতিষ্ঠ। সেখানে একটি রুপসী,কিশোরী কি দেখে মায়ায় জড়ালো?

(২) টাকা পয়সা,সম্পত্তির লোভে অনেক গরীব মা- বাবা তাদের সুন্দরী, গুনবতী মেয়েদেরকে ও আমিরুলের মতন সবদিক থেকে প্রতিবন্ধী ছেলের কাছে বিয়ে দিয়ে থাকে। একদিকে প্রতিবন্ধীদের ও অধিকার রয়েছে ঘর সংসার করার, আবার একটি গরীব ঘরের মেয়ের ও অধিকার, সাধ থাকে -একজন স্বাস্হ্যবান, সুস্হ, উপার্জনক্ষম, স্বাভাবিক স্বামীর ঘর সংসার করার।

এ দুয়ের সহজ ও ভালো সমাধান কি?

(৩) আমিরুলের মিষ্টি, রূপবতী বউ কিন্তু নিজ থেকে তাকে মেনে নিয়েছে। একজন কিশোরী -তরুনী মেয়ে সব ধরনের মানসিক, সামাজিক, দৈহিক চাহিদা থেকে বন্চিত থেকেও সে আমিরুলের সঙ্গে সংসার করতে হাসিমুখে রাজি।শারিরীক আনন্দের জন্য নয়, শুধু ভবিষ্যৎ এর কথা ভেবে তার জীবনের একমাত্র চাওয়া,আকাঙ্ক্ষা তার যেন একটি সন্তান হয়। হোক তা ছেলে বা মেয়ে। এ যুগে এমন ত্যাগী, নিবেদিতা স্ত্রী কতজনের আছে?

৪। কিন্তু এরকম ত্যাগ কি শুধু গরীবরা করবে? বা শুধু নারীরা করবে? কোন পুরুষ কি এমন কোন সবদিক থেকে প্রতিবন্ধী কোন কুৎসিত মেয়েকে এভাবে আপন করে নিবে?

এমন উদাহরণ কি আছে?

সাইকিয়াস্ট্রি, ইন্সটিটিউট অব ন্যাশনাল মেন্টাল হেলথ