banner

শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ ইং, ,

Daily Archives: April 15, 2024

 

বহে সমান্তরাল

ফাতিমা মারিয়ম


আম্মু, আমার না আব্বু আর তোমার সাথে কোথাও বেড়াতে যেতে ইচ্ছে করছে। আমরা এখন আর একসাথে থাকিনা কেন?

কেয়া চুপ করে সামিরার কথা শুনে যায়।

জানো, স্কুলে আমার বন্ধুদের কাছে গল্প শুনি তারা ছুটির দিনে বাবা মায়ের সাথে কত্ত জায়গায় বেড়াতে যায়! আমরা আবার কবে একসাথে বেড়াতে যাব?

কেয়া একটু হেসে মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। মেয়েকে কেয়া কিভাবে বোঝাবে সামিরা যা আশা করছে তা আর কখনো সম্ভব নয়। একসাথে তাদের আর কখনোই বেড়ানো হবেনা।

শুধুমাত্র মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কী কষ্টই না সে ভোগ করেছে। প্রায় দুইটা বছর অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করেছে। প্রথম দিকে নির্যাতন ছিল শুধু মানসিক। পরে গায়ে হাত তোলা পর্যন্ত গড়ায়। আর অবজ্ঞা অবহেলা তো ছিলই।

একটা মানুষ আর কত সহ্য করতে পারে? মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে, পরিবারের মান সম্মানের কথা ভেবে জাকিরকে বহু বোঝানোর চেষ্টা করেছে। ফেরানোর চেষ্টা করেছে।

পরিবারের পছন্দেই জাকিরকে বিয়ে করেছিল সামিরা। শুরুতে জাকির এমন ছিল না। আর দশটা পরিবারের মতই বেশ সুখ আর আনন্দে জাকির কেয়ার দিন কেটে যাচ্ছিল। কখনো বড় ধরনের কোন ঝামেলা হয় নি। বিয়ের প্রায় দুই বছর পর সামিরার জন্ম হয়। তিনজনের সংসারটা যেন আক্ষরিক অর্থেই ‘সুখের সংসার’ ছিল।

কিন্তু কীভাবে যে কি হয়ে গেল! কেয়া আজো তার হিসেব মেলাতে পারে না।

প্রায় তিন বছর আগের কথা। সামিরার বয়স তখন তিন বছর। কেয়া খেয়াল করে জাকিরের আচরণে কিছু পরিবর্তন হচ্ছে। সময়ের অনেক পরে বাসায় ফেরে। কারণ জানতে চাইলে দুর্ব্যবহার করে। প্রায়ই ছুটির দিনে সকালবেলা বাইরে চলে যায়। ফেরে সেই অনেক রাতে। বাসায় যতক্ষণ থাকে মোবাইল ফোনে কার সাথে যেন কথা বলেই যায়। কেয়াকে দেখলেই আচমকা কথা থামিয়ে দেয়।

ধীরে ধীরে কেয়ার মনে সন্দেহ দানা বাঁধতে থাকে। পরে সে সুযোগ মত কল লিস্ট চেক করতে গিয়ে সুমির নাম্বার পায়। কেয়া জাকিরের কাছে সুমির পরিচয় জানতে চায়। কিন্তু জাকির তাকে উল্টাপাল্টা বুঝিয়ে দেয়। জাকিরের বিভিন্ন আচরণে কেয়ার মনে সন্দেহ আরও বাড়তে থাকে।

একদিন সে সুমিকে ফোন করে। তখন সুমি অকপটে তার কাছে সব কথা স্বীকার করে। সুমি একটি এনজিওতে চাকুরী করে। আজ প্রায় এক বছর ধরে তাদের পরিচয়। অবসর সময়ে দুজনে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। কেয়া চোখে অন্ধকার দেখতে লাগল। সে কিভাবে এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবে?

জাকিরকে সে খুব বোঝাতে থাকে এই পথ থেকে ফিরে আসার জন্য। সে মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়েও জাকিরের কাছে আশঙ্কা প্রকাশ করে।

কিছুদিন পরে কেয়া জানতে পারে সুমির সাথে জাকিরের আর কোন যোগাযোগ নেই। সে এতে বেশ খুশিই হয়। কিন্তু এই খুশি বেশিদিন স্থায়ী হয় না। জাকির আবার আরেকজনের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। তারপর আবার এই সম্পর্ক শেষ হয়। আবার আরেকজন……।

সুমি থেকে শুরু করে প্রতিটা মেয়ের সাথে তার সম্পর্ক অনেকদূর পর্যন্ত গড়ায়। প্রায়ই সে কাউকে না কাউকে নিয়ে অফিসের ট্যুরের কথা বলে কয়েকদিনের জন্য ঢাকার বাইরে চলে যায়।
এবার কেয়ার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। সে সামিরাকে নিয়ে মায়ের বাসায় চলে আসে। মা বাবাকে সব কিছু খুলে বলে। উনারাই কেয়াকে বলেন তোর আর ফিরে যেতে হবেনা। তবুও কেয়া আশায় আশায় ছিল জাকির হয়ত অনুতপ্ত হয়ে তাকে নিতে আসবে! কিন্তু নিতে আসা তো দূরের কথা। একটু যোগাযোগও করেনা। মেয়ের প্রতিও তার বিন্দুমাত্র আকর্ষণ নেই! গতমাসে কেয়ার পক্ষ থেকেই ডিভোর্সের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে।

কেয়া একটি স্কুলে চাকুরী নিয়েছে। মেয়েকে নিয়ে বাবা মায়ের সাথে দিন কেটে যায়……
কেটে যাচ্ছে।

[এভাবে আমাদের সমাজে অনেক কেয়া জীবন যাপন করছে। এক বা একাধিক বাচ্চার দায়িত্ব মাকেই বহন করে তিল তিল করে বাচ্চাদের মানুষ করে তোলে। নিম্নবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত সব সমাজেই কেয়া বা সামিরা আছে। এছাড়াও আরও অনেক ধরনের বঞ্চনার শিকার হয়ে যেসব নারী দিনাতিপাত করছে তাদের নিয়েই আমার নতুন সিরিজ ‘ঝিনুক নীরবে সহে’।]

 

লজ্জাকর পেশা কি?

মুহাম্মদ হুমায়ন কবীর


কালো করে একটা মেয়ে ছোট একটা জবের জন্য বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সব রেস্টুরেন্টের মালিক সোজা বলে দিচ্ছে, দেখো, আমাদের এখানে কোনো লোক লাগবে না। অন্য কোথাও যাও। কালো মেয়েটা হতাশ হয়ে অন্য রেস্টুরেন্টে যায়।

এভাবে একদিন জব পেয়ে গেলো এক রেস্টুরেন্টে। মালিক প্রথম দিনই তাকে বলে দিলো, কখনও দেরি করে আসা চলবে না। তাহলে চাকরি বাতিল। সবকিছু মাথায় রেখেই মেয়েটা কাজ করে যাচ্ছে রেস্টুরেন্টে। খাবারের অর্ডার নিচ্ছে, তারপর খাবার পৌঁছে দিচ্ছে টেবিলে টেবিলে। খাওয়া শেষ হওয়ার পর টেবিল পরিস্কার করছে। কাজের কিছু অদক্ষতায় বকাও খাচ্ছে প্রায় প্রতিদিন। কখনও হয়তো কোনো কাস্টমারের সামনে থেকে কফির মগ নিতে গিয়ে গায়ে একটু কফি ফেলে দিয়েছে। কাস্টমার প্রচণ্ড রেগে নালিশ করেছে মালিকের কাছে। মেয়েটি হয়তো কাঁদো কাঁদো গলায় মালিককে সরি বলে কোনো ভাবে পারও পেয়ে গেছে।

গায়ের রঙ কালো বলে সম্ভবত রেস্টুরেন্টের অন্য ছেলেরা তাকে খুব একটা পাত্ত্বাও দেয়নি কিংবা কোনোদিন তার সহকর্মীর জন্মদিনে তার বাসায় গেলো। কেক কাটার পর যে খাবার দেয়া হলো, সহকর্মী লক্ষ্য করে দেখলো কালো মেয়েটি সেটি একদমই খেতে পারছে না। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, খাবারে সমস্যা কিনা। কালো মেয়েটি বললো, না, পেট ভরা, তাই খেতে পারছে না।

কোনোদিন হয়তো রেস্টুরেন্টের অন্যান্য সহকর্মীদের সাথে কম দামি গাড়িতে করে কোথাও ঘুরতেও গিয়েছিলো কালো মেয়েটি। কম দামি গাড়িতে বেশ কষ্টও হয়েছে তার। মুখ খুলে কিছু বলেনি কাউকে। সবকিছু চেপে গেছে আর ভেবে নিয়েছে, আমি অন্য দশটি মানুষের মতোই মানুষ। তারা পারলে আমি পারবো না কেনো।

দিন হয়তো এভাবেই যাচ্ছিলো। একদিন তার সহকর্মীর কেউ একজন দেখলো যে, কালো মেয়েটি রেস্টুরেন্ট থেকে বের হওয়ার পর আড়াল থেকে ছয়জন বিশালদেহি মানুষ তাকে ঘিরে রাখে। রেস্টুরেন্টে শুরু হলো গুঞ্জন, কানাকানি। এভাবে ঘটনা চলে যায় সাংবাদিকদের কাছে। বেরিয়ে আসে কালো মেয়েটির পরিচয়। সবাই জানতে পারে, কালো মেয়েটি প্রেসিডেন্টের মেয়ে। তারপর দেশে দেশে আলোচনা উঠে, নিউজ হয়।

বিশ্ব জেনে যায়, মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ছোট মেয়ে সাশা ওবামা নিজের পরিচয় লুকিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে কাজ করছেন । গ্রীষ্মকালীন ছুটির ফাঁকে ম্যাসাচুসেটসের মার্থাস ভিনিয়ার্ড নামের একটি দ্বীপের ওই রেস্টুরেন্টে কাজ নিয়েছেন তিনি। অনেকদিন পর্যন্ত সাশার সহকর্মীরাও তাকে চিনতে পারেনি। পরে রেস্টুরেন্ট ঘিরে সার্বক্ষণিক ছয়জন গোয়েন্দার অবস্থান বিষয়টিকে স্পষ্ট করে তোলে।

এদিকে বারাক ওবামার স্ত্রী মিশেল ওবামা বলেন, -“সন্তানদেরকে একটা বয়সের পরে রাজকীয় বিলাসিতা ছাড়তে বাধ্য করেছি। কারণ তাদের সাধারণ মানুষের সাথে মিশতে হবে। অন্য দশটা মানুষের মতোই বাঁচতে শিখতে হবে তাদের।”

এবার আপনি বাংলাদেশের রাজনীতিবিদগণ এবং তাঁদের সন্তান বা আত্মীয়-স্বজনের কথা ভাবুন। নিজেদের অবস্থার কথাও ভাবা যেতে পারে।