banner

মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ইং, ,

Daily Archives: April 21, 2024

 

কেন হচ্ছে বিবাহ বিচ্ছেদ?

ফাতেমা শাহরিন


কাজটি অত্যন্ত কঠিন বলা যে, সমাজে অবক্ষয়, নাকি অপসংস্কৃতির প্রভাব, অথবা নারী পুরুষভেদে মারাত্মকভাবে ‘ইগো’ প্রব্লেম। হা, আত্ম অহমিকা বন্ধনকে নাজুক করে দেয় এটা সত্যি কিন্তু আধুনিকতা এবং উচ্চ শিক্ষার হার যে হতে পারে তা বড় বড় পত্রিকায় আসছে শিরোনাম হয়ে। আজকের আধুনিক এবং দ্রুতগতির জীবনে সম্পর্কের বিচ্ছেদ রাষ্ট্রীয় কোন নতুন সমস্যা হয়ে দাড়িয়ে পড়বে কিনা বলা মুশকিল। কেন এই সম্পর্ক গুল ভালবেসে গড়েও ভেঙ্গে পড়ছে?

আসুন দেখি কিছু পয়েন্ট:

১) সেক্সচুয়াল সমস্যা

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং এক নম্বর সমস্যা হল সেক্সচুয়াল সমস্যা। লোকলজ্জা অথবা অজানা জ্ঞান এব ভুল শিক্ষার জন্য একটি সুমধুর দাম্পত্য জীবন সূচনা লগ্নে অন্ধকার ছায়াতলে ডুবে যেতে পারে। এজন্য সুস্থ যৌন মিলন একটি অপরিহার্য অঙ্গ। যখন স্বামী-স্ত্রী পরিতৃপ্ত যৌন মিলনে ব্যর্থ হয় তখন তাদের মাঝে দূরত্ব বাড়তে থাকে। পরিশেষে ঘুমের ঘর থেকেই দাম্পত্য জীবন সমাপ্তির দিকে এগিয়ে যায়।

২) সম্পর্কের অবনতি

দাম্পত্য জীবনে মতবিরোধ ও মনোমালিন্য থাকা অস্বাভাবিক নয়। তবে তাকে বেশী বাড়তে দেয়া যাবে না। তা যদি এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, কেউ কারো সাথে কথা বলছে না তাহলে সমস্যা জটিলতর হয়ে ক্রমান্বয়ে তা বিবাহ বিচ্ছেদ পর্যন্ত গড়ায়।

৩) নির্যাতন

নির্যাতন তিন প্রকার, কখন শারীরিক, বস মানসিক, সেক্সচুয়াল। যা একটি সম্পর্ককে হত্যা করে। এ ক্ষেত্রে সব চেয়ে বড় বিপদ জনক কারণ হল, দৈহিক ভাবে অত্যাচার, মার-পিট ও রুক্ষ আচরণ অথবা মানসিকভাবে নির্যাতন তথা অপমান, হেয় প্রতিপন্ন, গালাগালি করা। বৈবাহিক বন্ধনে সেক্সচুয়াল নির্যাতন ভয়ংকর রূপে হলেও সমাজে হয়ে অনেক নারী বা পুরুষ নিরবে চুপ থাকে। কিন্তু দীর্ঘদিন যুদ্ধ শেষে সম্পর্ক মরে যায়।

৪) দাম্পত্য জীবনে অনীহা

দাম্পত্য জীবনের ব্যাপারে বিতৃষ্ণা একটি জীবনে এক ঘেয়েমী ও বিরক্ত ছড়িয়ে দেয়। এটি সংসার ভাঙ্গার একটি কারণ। দীর্ঘ দিন ঘর সংসার করার পর যদি দেখা যায়, ভালোবাসার উষ্ণতা শীতল হয়ে পড়েছে। পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেছে। তাহলে পরিণতিতে তা তালাকের দিকে গড়ায়। দীর্ঘদিন গোপন প্রেম, তারপর গোপন বিয়ে, এক সময় সবকিছু ফাঁস। দাম্পত্য জীবনের প্রতি অনীহার জন্ম নেয়।

৫) মাদকাসক্তি

মাদকাসক্তি ব্যক্তির নানান রকম সমস্যা দেখা দেয়, রাগ বেড়ে যায়, সন্দেহ জন্ম নেয়, এমনি প্রচন্ড অত্যাচারী হিসেবে পরস্পর এর প্রতি সহিংস্র হয়ে পরে। দাম্পত্য জীবনকে ধ্বংসের অতল তলে নিয়ে যায়। এর ধ্বংসাত্তক দিক অনেক। ফলে.. প্রচুর অর্থ অপচয়, অপর পক্ষের প্রতি অবহেলা প্রদর্শন, শারীরিক নির্যাতন, সন্দেহ জনক অবৈধ সম্পর্ক আর পরিশেষে দাম্পত্যে জীবন ধ্বংস ‘তালাক’।

৬) বিয়ের পর অবৈধ সম্পর্ক

স্বামী অথবা স্ত্রীর পক্ষ থেকে যে কেউ যদি পরকীয়ায় লিপ্ত থাকে তাহলে পরবর্তীতে তা বৈবাহিক জীবনের ইতি টানতে বাধ্য করে। তা জীবনে একটি মারাত্মক হুমকি হয়ে দাড়িয়ে যায়। পরকীয়া মূলত: দাম্পত্য জীবনে বিশ্বাস ঘাতকতার শামিল।

আল্লাহ তায়ালা প্রতিটি দম্পতিকে ভাঙ্গনের হাত থেকে রক্ষা করে তাদেরকে একটি সুস্থ, সুন্দর, মধুময়, ও বরকতময় পরিবার গঠন করার তাওফীক দান করুন। এ জন্য পারষ্পারিক ভালোবাসার উষ্ণতা ধরে রাখার জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করা প্রত্যেক জরুরী। রেফারেন্স: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সউদী আরব। সুখী ও সুন্দর পরিবার গঠন করবো।

মনোবিজ্ঞান

 

আলোক কণিকার পিছু পিছু

ডা.ফাতিমা খান


প্রতিদিন রোগী দেখা শেষ করে বাসায় ফিরতাম রাত দশটায়। বাসায় এসে ঠান্ডা পানিতে গোসল সেরে আয়েশ করে ধোঁয়া ওঠা চা/কফি খাওয়া ছিল আমার সে সময় প্রতিদিনের অভ্যাস। হয়তো ভাবছেন, এত রাতে চা-কফি ? ঘুম আসবে তো ?
আসবে…ঘুম আসতে চাইলে আসবেই, আর না আসলে কিছু করার নাই, চা-কফির দোষ দিয়ে লাভ নেই, আমার ঘুম এমনিতেই খুব কম । সারারাত ‘নির্ঘুম প্রহরী’ হয়ে জেগে থাকার অভ্যাস আমার বহুদিনের।

বাসায় ঢোকা মাত্র প্রায়ই দিনই কারেন্ট চলে যেত। আমাদের এলাকার লোডশেডিং এর সময়-জ্ঞানটা ছিল অসাধারণ! প্রতিদিন একই সময় বিদায় নিত, আবার ঠিক সময়মতই চলে আসত। আমার বুয়া রিমির মা ঝটপট ‘বিকল্প বাতি’র ব্যবস্থা করতে করতে ভেংচি কেটে বলত, ”ভাবী আইছে না, অহনই কারেন্টের যাওন লাগব”।

আমি হাসতাম। রিমির মায়ের এই কথায় একটা অব্যক্ত মমতা ছিল। ব্যাপারটা আমার সয়ে গেলেও রিমির মার কষ্ট হত এই ক্লান্ত আমার জন্য। ঢাকা শহরে দিনশেষে সহি-সালামতে ঘরে ফিরতে পেরেছি এই তো অনেক … প্রতিদিন শুকরিয়া নামাজ পড়া উচিত। কারেন্ট চলে গেলে যাক, আমি আমার মত আমার চা/কফির কাপটা নিয়ে সোজা চলে যেতাম আমার ছোট্ট বারান্দাটায়।

হিজিবিজি দালানের ঢাকা শহরেও উপরতলার ফ্ল্যাটগুলোর খোলা জানালা বা বারান্দা দিয়ে চমৎকার ফুরফুরে বাতাস আসে। আর যদি হয় দক্ষিণমুখী বারান্দা, তাহলে ত আর কথাই নাই ! পূর্ণিমারাতে চাঁদের আলোর একটুখানি হলেও দালানের গা গড়িয়ে তৃষার্ত শহরে ছড়িয়ে পড়ে। বর্ষার দিনে ঝিরঝির বৃষ্টি সামান্য হলেও বারান্দাটা ভিজিয়ে দেয়। এই বারান্দায় বসেই আমি ভেজা মাটি, বৃষ্টি আর বাতাসের একটা মিশ্র সুবাস নিতাম।

সেদিন রাত বাজে প্রায় ১ টা । ল্যাম্পের আলোয় বই পড়ছিলাম। এসময় বাসার সবাই দিব্যি ঘুমে তলিয়ে থাকে। সবাই বলতে আমার ছেলে, রিমির মা (ঘরের কাজের জন্যই তাকে রাখা হয়েছিল কিন্তু তাকে সবাই আমার আত্নীয়া মনে করত) আর রুবি, আমার ছেলের খেলার সাথী।
রিমির মা কখন যে এসে আমার সামনে দাড়িয়েছে টের পাইনি। টেবিল ল্যাম্প এর কুসুম আলোতে তাকে কিছুটা উজ্জ্বল লাগছে, রিমির মার চেহারায় অদ্ভুত একটা মায়াবী আর দুখী দুখী ভাব আছে। আজ মনে হচ্ছে এখানে আরও একরাশ মেঘ এসে জড় হয়েছে !

– কিছু বলবে?
_মা ফুন করছিল ভাবী।

– কি বলল ? সব খবর ভাল ? তোমার রিমি কেমন আছে ?
_ভাবী, রিমির বাপ আইছে বাড়িত।
– তো ?

_রিমিরে নেবার চায়। মাও এর হাতে পায়ে ধরে মাফ চাইছে। আমাদের রাখি আর কুনুখানে যাইব না।

এরকম শপথ রিমির বাপ আগেও অনেকবার করেছে, আবার অনেকবার ভেঙ্গেছেও । রিমির জন্মের আগেই এই লোকটা তার বউ আর অনাগত সন্তানকে ফেলে চলে গিয়েছিল অন্য কারো সংসারের অর্ধাংশ পূর্ণ করতে। এরপর ফিরে এসেছিল ঠিক, কিন্তু কিছুদিন পর সেই আবার একি ঘটনা ঘটায়। প্রতিবার সে হাতে পায়ে ধরে মাফ চায়।

যে বারবার কথা রাখবে না তার কথা দেয়ার কোন অধিকার আছে কি ?
রিমির মা রাও যে কি! এত অন্যায় সহ্য করে কেন?
কিন্তু ওদেরই বা কি দোষ!

আমাদের দেশের সমাজটাই তো এমন, যেকোন সাংসারিক বা সামাজিক ক্রন্দলের নন্দঘোষ হল বেশীরভাগ ক্ষেত্রে মেয়েরা। এদের কাজ হল মুখে ছিপি এঁটে, কানে তুলা দিয়ে, চোখে কালো কাপড় বেঁধে কোমড়ে বাঁধা দড়ি মোতাবেক চলতে থাকা। এই অদৃশ্য দড়ির পরিচালক বদলযোগ্য। দড়ি-চালক ভালো হলে তো ঠিক আছে, কিন্তু খারাপ হলে জীবনটা একেবারেই অসহনীয় করে দেয়।

আদর্শহীন মুর্খ সমাজব্যবস্থার এই একটা বিশাল সমস্যা। কিন্তু এগুলো কে বোঝাবে কাকে ?

– তুমি এখন ঘুমাও তো রিমির মা। কাল ভেবে দেখব।

কিছুই ভাবতে পারছিলাম না। আমার ছোট্ট সংসারে রিমির মায়ের অবদান ছিল অনেক বেশী। টাকা-পয়সা দিলে যতই কাজের মানুষ পাওয়া যাক না কেন, অন্যের সংসারকে আপন করে সাজিয়ে গুছিয়ে সবটুকু ভালবাসা দিয়ে কাজ করবে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। রিমির মায়ের স্বভাব-চরিত্র আর অভ্যাসগুলো অন্য আর দশজন কাজের মানুষের মত ছিল না। তাছাড়া কোথাও না কোথাও ওদেরকে আমার একাকীত্বের সাথীও মনে হত। জীবনের অতিরিক্ত ব্যস্ততায় আমি মেশিনের মত হয়ে গিয়েছিলাম , মাঝে মাঝেই কোন অনুভূতি কাজ করত না । আমার স্বস্তিময় জগতটা তখন খুব ছোট..শুধু আমার ছোট্ট ঘরটুকু। সারাদিন রোগবিদ্যা, ছাত্র-ছাত্রী, রোগী আর চিকিৎসার পাট চুকিয়ে ছুটে আসতাম আমার ছোট্ট জগতে, যেখানে আমার সোনামণিটা আমার জন্য অপেক্ষা করত সারাদিন, ওর উচ্ছলতা, দূরন্তপনা আর মিষ্টি হাসির আমেজে ভরে থাকত আমার স্বর্গসম নীড়।
আমার অনুপস্থিতিতে রিমির মা-ই ওকে বুকের মাঝে আগলে রেখেছে। রিমির মা চলে গেলে আমার চেয়ে বেশী কষ্ট হবে ওর। ওর অবুঝ চোখ দুটো খুঁজে বেড়াবে অনেক দিনের চেনা কোলটাকে! কিন্তু শুধু নিজের কথা ভাবলে তো আর চলবে না, আমিই বা এত স্বার্থ্পর হই কেমন করে ??…কি করি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।

বিদায় বেলায় রিমির মা অনেক কেঁদেছিল। সে কান্নায় কোন শব্দ ছিল না। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছিল ওখানে অসহায়ত্ব চিরস্থায়ীভাবে বাসা বেধেছে। অনিশ্চয়তার এক আর্তচিৎকার বেরিয়ে আসতে চাইছে ওর মুখ ফুটে। যে মানুষ বারবার ধোকা খেয়েছে সে জেনে বুঝে আরেকবার ধোকার জালে তখনই পা ফেলে যখন কোথাও না কোথাও তার বাধ্যবাধকতা থাকে।

রিমি ওর দূর্বলতা। ও বড় হয়েছে। তার ভবিষ্যত চিন্তা করে রিমির মা আবার ফিরে যাবে শ্বশুরবাড়ি। পরে কি হবে, আদৌ তার মেয়েটার পিতৃ-ঠিকানায় আশ্রয় দীর্ঘস্থায়ী হবে কিনা এগুলো ভাবার অবসর নাই। ওদের জীবনটা কূলহীন নদীতে ভাসিয়ে দেয়া নৌকাটার মত। ঝড়, ঝঞ্জা, বাতাস, জোয়ার-ভাটায় কখনও নাও টলমান তো আবার কখনো মৃদু গতিতে চলমান। রাত হলে দিনের অপেক্ষা…দিন এলে রাতের আয়োজন। অনেক কিছু না-পাওয়া জীবনেও ওদের সীমাহীন স্বপ্নই একমাত্র সম্বল।

যুক্তি বা বাস্তবতার পেশীবহুল হাতটা ওদের স্বপ্নের সাথে পাঞ্জা লড়ে হার মানে বারবার। বিত্তবান আর বিত্তহীনদের স্বপ্নের মাঝে একটা বিশাল তফাৎ হল বিত্তবানদের স্বপ্নগুলো ওদের ঘুম কেড়ে নেয়… আর বিত্তহীনরা স্বপ্নই দেখে ঘুমিয়ে যাওয়ার পর। রিমির মায়ের চোখে মুখে এরকম এক স্বপ্ন আমি দেখেছি অনেক বার। সেই স্বপ্ন পূরণের জন্য সে অবিরাম ছুটে চলেছে…… ।

একদিন আফসোস করে বলেছিল, ” পোলা হইলে তো কথাই ছিল না ভাবী, মাইয়া।

লেখিকা কর্মরত: আল হিবা মেডিক্যাল গ্রুপ, জেদ্দা, সৌদি আরব।