banner

বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪ ইং, ,

Daily Archives: March 13, 2024

 

শিশুদের মনোজগত ভ্রমণ

আফরোজা হাসান


অফ ক্লাসে যে কোন এক ক্লাসে ঢুকে ঘাপটি মেরে বসে জ্ঞানার্জন করাটা আমার সবচেয়ে প্রিয় শখগুলোর মধ্যে একটি!

ঘাপটি মেরে বসার জন্য সবসময়ই আমার ফাস্ট চয়েজ থাকে যুক্তিবিদ্যার ক্লাসগুলো!

একদিন যুক্তিবিদ্যার ক্লাসে প্রফ প্রশ্ন করেছিলেন, যুক্তিবিদগণ কাদের কাছ থেকে অতি উন্নত মানের যুক্তির টিউশন নিতে পারে বলো তো?

ক্লাসের সবাই টেনশনে পড়ে গেলেও আমি অনেকটা অজান্তেই বলে উঠেছিলাম, শিশুদের কাছ থেকে।

প্রফ বিকট শব্দে হা হা করে হাসতে হাসতে বলল, একদম ঠিক বলেছো! আমি বই পড়ে যতটা না যুক্তি শিখেছি তারচেয়ে বেশি শিখেছি আমার তিন ছেলে আর দুই মেয়ের কাছ থেকে! প্রফের সাথে সুর মিলিয়ে বললাম, আমিও পড়াশোনা না করেই যুক্তিবিদ্যার উপর বড় বড় ডিগ্রী অর্জন করে ফেলেছি আমাদের পরিবারের বিচ্ছুকূল আর আমার শিষ্যকূলদের কারণেই!

শিশুদের সাথে যারা নিয়মিত কথা বলেন, তারা সবাই এই কথাটি এক বাক্যে স্বীকার করে নেন যে, নিজের কর্মের পেছনে যুক্তি প্রদর্শনে শিশুদের কোন তুলনা চলে না! তারা এমন সব অকাট্য যুক্তি দেয় যে বাবা-মাকে গালে হাত দিয়ে চিন্তায় মগ্ন হতে হয়!

ঠিক তেমনি এটাও ঠিক শিশুদেরকে কোন কিছু বোঝানোর ক্ষেত্রে যুক্তির প্রয়োগ করলে সেটা অনেক বেশি কার্যকরি ও ফলপ্রসূ হয়! যেহেতু শিশুরা নিজেরা ওদের কাছে পেছনে যুক্তি দেখায়! সেহেতু কোন কাজের পেছনে ওদেরকেও যুক্তি দেখাতে পারলে বেশ সহজেই মেনে নেয়! আমার পুত্রকে যেমন কোন কিছু করতে বলার সাথে সাথে প্রশ্ন করে, কেন করবো? যদি কারণটা সুন্দর করে বুঝিয়ে বলি অপছন্দনীয় বা একটু কষ্টকর হলেও যে হেলে দুলে কাজটা করে বা অন্তত চেষ্টা করে!

বাংলা লেখা ও পড়া শিখতে নাকীব ছোটবেলা থেকেই নারাজ। আমিও খুব একটা প্রেশার দেইনি যেহেতু তার যুক্তি ছিল সে তো বাংলাদেশে থাকে না, মাঝে মাঝে শুধু বেড়াতে যাবে! সেজন্য বাংলা কথা বলতে পারাটাই যথেষ্ট। কিন্তু যখন ইসহাক খান ভাইয়ার অফিস থেকে আমার বই বাসায় নিয়ে আসা হলো। নাকীব লাফাতে লাফাতে গিয়ে সবার আগে বই হাতে নিলো। কিন্তু উল্টে পাল্টে দেখার পর যখন কিছুই বুঝতে পারলো না খুবই ব্যথিত হলো! এরপর যখন শুনলো যে আমি বইতে তার কথাই লিখেছি! সে খুবই উৎসাহিত বোধ করছিল জানার জন্য। কিন্তু যেহেতু বাংলা পড়তে পারে না তাই কি লেখা আছে বুঝতে পারলো না কিছুই।

কাঁটা ঘা’য়ে নুনের ছিটা দেবার জন্য আমি দুঃখী কন্ঠে বললাম, কত শখ করে আমি তোমার কথা লিখেছি বাবাসোনা! কিন্তু তুমি কিছুই পড়তে পারবে না! সাথে সাথে নাকীব সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো বাংলা শেখার! এখন তো আমি সময়ের অভাবে ফাঁকি দিতে চাইলেও সে খোঁচাতে থাকে বাংলা শেখার জন্য।

যখন চাইল্ড সাইকোলজির উপর কোর্স করেছিলাম প্রফ ক্লাসে ঢুকে বলেছিলেন,

তোমরা কি তৈরি এই পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত, সবচেয়ে বুদ্ধিমান, সবচেয়ে চিন্তাশীল প্রাণীটির নতুন প্রজন্মকে জানা-বোঝা ও চেনার জন্য?

তাদের মনের রাজ্যে অবাধ বিচরণের জন্য? তাদের কল্পনার রাজ্যে হাবুডুবু খাওয়ার জন্য?

তাদের সাথে আকাশে উড়ার জন্য?

খন্ড খন্ড মেঘের উপর লাফিয়ে লাফিয়ে চলার জন্য?

ছোট্ট থেকে ছোট্ট বিষয়ে বিস্ময়ে বিকশিত হবার জন্য?

প্রশ্ন বিশারদ হয়ে যাবার জন্য?

এই যেমন, পাখী কেন উড়ে, ফুল কেন ফোটে, প্রজাপতি কেন এত রঙিন?

আমার কেন ডানা নেই?

দাদুর কেন দাঁত নেই?

বাবা কেন রোজ অফিসে যায়?

ধূর ছাই সব্জি কেন খেতে গোশতের মত লাগে না?

আচ্ছা দিদার চামড়াকে আয়রণ করে দিলে কি কুঁচকানো ভাব কেটে যাবে?

ব্লগে শিশুদের মনোজগত ভ্রমণকারী দু’চার জনই পাবো জানি! তাদেরকে উদ্দেশ্যে করেই বলছি, চলুন কয়েকটা দিনের জন্য ডানা মেলে ঘুরে বেড়াই সেই জগতে…! একসময় আমরাও যার বাসিন্দা ছিলাম! দুনিয়ার নানান ম্লানতায় আমাদের যে মনোজগতের ব্যাপ্তি আজ বড় বেশি সংকীর্ণ! প্রায় নিভু নিভু যার আলো……।

মনোবিজ্ঞান

 

‘চার ধরনের মানুষ আছে’

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক


(১) আত্মস্বার্থবাদী

যারা নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থ-উদ্দেশ্যের বাইরে কোনো কিছুকে তেমন একটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করে না। এদের মধ্যে যারা স্বীয় ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য যে কোনো কিছু করতে পারে তাদেরকে আমরা সুবিধাবাদী বলি। আর যারা নিজের সুযোগ-সুবিধা চাইলেও অবৈধ ও অন্যায় পথে অগ্রসর হতে চায় না তাদেরকে আমরা নিরীহ নাগরিক হিসাবে সম্মান করি। তারা হলেন সাধারণ পর্যায়ের ভাল মানুষ।

(২) আদর্শবাদী

কিছু লোক আছে যারা কোনো না কোনো আদর্শের সাথে নিজেকে আইডেন্টিফাই করে। তারা নিজেদের আদর্শগত ভাল-মন্দের মাপকাঠি অনুসারে নিজেরা কোনোমতে চলে বটে। কিন্তু বাদবাকীদের ব্যাপারে, বিশেষ করে বিদ্যমান এস্টাবলিশমেন্টের নানা রকমের অন্যায়ের বিরুদ্ধে এরা উচ্চকণ্ঠ। আশেপাশে কার কার কী কী ভুল আছে তা তারা সোৎসাহে বলে বেড়াবে। এরা নিজেদেরকে বুদ্ধিজীবী হিসাবে উপস্থাপন করে। দেখবেন, আদর্শের মেশিগান হাতে ব্রাশ ফায়ার করার জন্য এরা সদা সর্বদা প্রস্তুত।

(৩) নেতৃত্বপ্রিয়

কিছু লোক আছে যারা সব সময়ে গণ মনোভাবের সাথে থাকে। পাবলিক যা বলে তারাও তা বলে। এতে করে তারা সামাজিক ও প্রশাসনিক নেতৃত্ব অর্জন করে। ভাল-মন্দের ব্যাপারে এদের নিজস্ব বিবেচনাবোধ খুব দুর্বল। দৃশ্যত জনসেবায় নিয়োজিত হলেও আসলে একটা পক্ষ নিয়ে লিডারশীপ হাসিল করাই এদের লক্ষ্য।

(৪) সমাজকর্মী

এরা গণ চরিত্রসম্পন্ন। নিজের স্বার্থের চেয়ে এরা সমাজ, রাষ্ট্র ও মানবতার কথা বেশি ভাবে। আদর্শকে চাপিয়ে দেয়ার পরিবর্তে তারা মানুষের মধ্যে গ্র্যাজুয়েল প্রসেসে সমাজ পরিবর্তনে আগ্রহী। তাই, মানুষের মন জয় করাকে তারা অগ্রাধিকার দেয়। এই ধরনের লোকেরা নেতৃত্বপ্রিয়দের মতো আপোষকামীও হয় না, আদর্শবাদীদের মতো নির্দয় সমালোচকও হয় না। তারা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মানুষের কাছে যায়। মানুষ তাদের কাছে হেদায়েতের জন্য আসবে, তখন তারা হক্ব কথাটা বলবে, মানুষ তাদেরকে নেতৃত্বের আসনে বসাবে তখন তারা ন্যায় প্রতিষ্ঠা করবে, এজন্য তারা অপেক্ষা করে না।
আমি চতুর্থ ক্যাটাগরিতে নিজেকে দেখতে চাই।
আপনি?

সহযোগী অধ্যাপক,
দর্শন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

 

জলে ভাসা পদ্ম

ফাতিমা মারিয়ম


আমি ক্লাস সেভেন এ পড়ার সময় আমার মা মারা যায়। দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর তার মৃত্যু হয়। মা’র খুব জটিল একটা রোগ হয়েছিল। ধরা পড়ার প্রায় দেড় বছর বেঁচে ছিলেন। ডাক্তাররা আমার মায়ের রোগ নিরাময়ের জন্য অনেক চেষ্টা করেছিল। কোন চিকিৎসাই মাকে সারিয়ে তুলতে পারছিল না! দিনদিন মা মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। মার মৃত্যু হয় হাসপাতালে।

আমাদের ছোট্ট সংসার……সুখের একটি রাজ্য। আমি মা আর বাবা। সব কিছুই কেমন যেন লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল। আমি আর বাবা ভীষণ একা হয়ে পড়লাম।

মা মারা যাওয়ার তিন মাস পর নানা-নানু, মামা-খালা, চাচা-ফুফুরা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়ে বাবা আর আমার একাকীত্ব ঘোচানোর জন্য আমার একজন ‘আম্মু’ নিয়ে আসল। খালামণি, নানু ও ফুফুরা সবাই মিলে নতুন মাকে ‘আম্মু’ বলে ডাকতে শেখাল। আমি তাই প্রথম থেকেই উনাকে আম্মু বলে ডাকি।

ধীরে ধীরে বাবা স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে। ছুটির দিনে আমাকে আর আম্মুকে নিয়ে বিভিন্ন আত্মীয় স্বজনের বাসায় বেড়াতে যায়। হঠাৎ কোন একদিন আমাকে এসে বলে, নিশু চল আমরা আজ বাইরে কোথাও খেতে যাব। কোথায় যাওয়া যায় বল তো?’ আমরা তিনজনে মিলে প্ল্যান করে কোথাও যাই। বাইরে অনেকক্ষণ থেকে বাসায় আসি। আমরা সবাই সবাইকে নিয়ে ভালোই ছিলাম।

কিন্তু আমার জন্য এই দিনগুলিও বেশিদিন রইল না।

দিন দিন আমার আম্মু যেন কেমন হয়ে যাচ্ছে! আমি মনে করতাম আমার সাথে উনার সম্পর্ক বেশ ভালো। আমি মনে প্রাণে উনাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছিলাম। ভাবতাম উনিও আমাকে সেইভাবেই গ্রহণ করেছেন।

ধীরে ধীরে উনি আমার প্রতি কেমন যেন অনীহা প্রকাশ করা শুরু করলেন। আমি বুঝতাম। কিন্তু কাউকে কিছু বলতাম না। কারণ আমি ভাবতাম আমি নিজেই হয়ত ভুল বুঝছি।

প্রায়ই আমি স্কুলে যাবার সময় টিফিন পেতাম না! বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে স্কুলে যেতাম। স্কুলের ক্যান্টিনে টিফিন কিনে খেতাম। বাসায় ফেরার পরও দেখতাম যে আমার জন্য কোন খাবার নেই।

দুপুরে বাসায় আম্মু আর আমি থাকি। বাবা সকালে নাস্তা খেয়ে অফিসে যায় আর ফেরে রাতে। তাই দুপুরে কি হয় না হয় তিনি জানেন না।

এ ঘটনা কয়েক দিন ঘটার পর আমি বাবাকে জানাই। বাবা কোন পদক্ষেপ নেয় না! তাই আমার প্রতি আম্মুর অবহেলা দিন দিন আরও বাড়তে থাকে।

এমন দিনও আমার যেত দুপুরবেলা বাসায় ফিরে যখন দেখতাম যে টেবিলে বা ফ্রিজে কোন খাবার নেই তখন পট থেকে মুড়ি নিয়ে শুকনো মুড়ি বা বিস্কিট খেয়ে দিন পার করেছি। রাতে বাবার সাথে বসে যখন ভাত খেতাম তখন আমি বাবাকে বুঝতেই দিতাম না যে আমি দুপুরে ভাত খাইনি।

আম্মুকে খুশি রাখার জন্য আমার বাবার আচরণেও দিন দিন পরিবর্তন আসছিলো। প্রায়ই দেখি আমাকে ছাড়া আম্মু আর বাবা বাইরে ঘুরতে যায়। তারা বাইরে গেলে আমি মন খারাপ করে থাকি। একা একা আমকে বাসায় রেখে যেতে কি আমার বাবার একটুও খারাপ লাগেনা?

বাবার প্রতি ক্ষোভ বাড়তে থাকে। আমার প্রতি বাবা এতটা উদাসী হয়ে গেল কিভাবে? আমিতো বাবার একমাত্র মেয়ে! এভাবে আরও কয়েক মাস কেটে গেল।

আমার বয়স কম। কতটুকুই বা সহ্য করতে পারি!! ফুফুকে সব জানালাম। ফুফু বাবার কাছে জানতে চাইলেন এসব হয় যে তুই কোন পদক্ষেপ নিস না কেন? বাবা ফুফুকে জানালো যে মিতা (আম্মুর নাম) ভীষণ খামখেয়ালী টাইপের! তাই ওকে বেশি কিছু বলি না!

ফুফু আমাকে উনার বাসায় নিয়ে আসল। ফুফুর বাসা থেকে স্কুল অনেক দূরে। বাসে করে আসা যাওয়া করতে হয়! ফুফু এবং আমাদের সবার ধারনা ছিল কিছু দিন গেলে বাবা এবং আম্মু এসে আমাকে নিয়ে যাবে। কিন্তু এক বছরের বেশি সময় হয়ে গেল বাবা আমাকে নিতে আসেনি।

দেড় দুই মাস পর পর আসে! খুব অল্প সময় থাকে। কিছু টাকা হাতে দিয়ে যায় (স্কুল ও কোচিং এর খরচ)। আমি বাসায় যেতে চাই কি না তাও কখনো জানতে চায় না! দেখে মনে হয় বাবা এখন বেশ সুখেই আছে। ফুফু আমাকে সব সময় বলেন-‘তুই নিজ থেকে কখনো যাওয়ার কথা বলবি না। আমরা দেখি তোর বাবা কি বলে?’ কিন্তু ফুফু জানে না, কেউ জানে না আমি সব সময় মনে মনে একটি আহ্বানের অপেক্ষায় থাকি! আমার বাবা একদিন আমাকে এসে বলবে-‘আয় খুকু আয়…!’

অনলাইন এক্টিভিস্ট