banner

বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ইং, ,

Daily Archives: April 23, 2024

 

বিয়ে হোক বাহুল্য ব্যয় বর্জিত

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক


বিয়েতে বাহুল্য ব্যয়ের অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে যে লেখাটা গত পরশু শেয়ার করেছি সেটির ফরোয়ার্ডিং হিসাবে দেয়া সংক্ষিপ্ত মন্তব্যগুলো ছিল বেশ কড়া। সুখের বিষয় হলো উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারীসহ ইতোমধ্যে ২৬২ জন এটি লাইক করেছে। তন্মধ্যে ৩২জন এটি শেয়ারও করেছে। এই সামাজিক সমস্যার ব্যাপারে চিন্তাশীল ব্যক্তিবর্গ উচ্চকণ্ঠ হচ্ছেন। এটি খুব ভালো লক্ষণ।

আশা করি এক দশকের মধ্যে বাহুল্য ব্যয় বর্জিত সাদামাটা বিয়ে অনুষ্ঠানের সামাজিক রীতি এ দেশে প্রতিষ্ঠিত হবে। অন্ততপক্ষে অন্যতম ডমিন্যান্ট সোশ্যাল ট্রেন্ড হিসাবে এটি উঠে আসবে বলে আমার ধারণা।

একটা সুস্থ সমাজ ব্যবস্থার জন্য ক্ষমতা, অর্থ ও বস্তুগত সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টন ব্যবস্থার পাশাপাশি মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি নিবারণের ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থা থাকা জরুরী। কোনো অস্বাভাবিক পরিস্থিতিকে আপনি জরুরীভিত্তিতে যে কোনো প্রকারে মোকাবিলা করবেন। সম্ভাব্য কম ক্ষতিকে মেনে নিয়ে আমিও বৃহত্তর লক্ষ্যকে অর্জন করার চেষ্টা করবো।

প্রয়োজনে নানা ধরনের আপতকালীন ব্যবস্থা বা compatibility mood এডপ্ট করাতে সমস্যা নাই। সমস্যা হলো, জরুরীভাবে অগত্যা পরিস্থিতিতে গৃহীত সাময়িক ব্যবস্থাকে যখন কোনো সমাজ স্থায়ী ও স্বাভাবিক পন্থা হিসাবে গ্রহণ করে।

এ ধরনের নাজুক বিষয়ে উদাহরণ দিয়ে কথা বলাই ভালো। দুপুরে খাওয়ার সময়ে ভাত-তরকারী দিয়ে পেটপুরে নরমাল খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা না হলে কেউ চা-মুড়ি খেয়ে কোনো মতে খিদা মিটাতে ও সময় কাটাতে পারে। তাই বলে কেউ যদি ক্ষুধা পেটে ভাত না খেয়ে হামিশখন চিপস আর চনাচুর খেতে থাকে, তখন সেটা নিশ্চয়ই সেই ব্যক্তি ও সমাজের গুরুতর সমস্যা।

একটা সমাজে অনেক সমস্যা থাকতে পারে। সমস্যা থাকাটা সমস্যা নয়, সমস্যাকে স্বীকার না করাটাই হলো এক নম্বরের গুরুতর সমস্যা। দেরীতে বিয়ে সব দিক থেকে বিরাট সমস্যা। তা অধিকতর ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে না। আয়-উপার্জনের ব্যবস্থা না হওয়ার কারণে উপযুক্ত সময়ে ছেলে-মেয়েরা বিয়ে করতে পারে না। গোদের উপর বিষ ফোঁড়ার মতো দেরীতে বিয়ের এই ‘কালা জ্বর’ আরো প্রলম্বিত হয় বিয়েতে বাহুল্য ব্যয়ের কারণে।

যে যাই মনে করেন না কেন, আমার কাছে ব্যাপারটা সিম্পল। প্রাপ্ত বয়স্ক দু’জন নর-নারী মিলিত হবে। পরষ্পর হতে নিজেদের প্রয়োজন পূর্ণ করবে। একজন আরেকজনকে ব্যক্তিগত সুরক্ষা দিবে। একই সাথে এই ‘বিশেষ ব্যক্তিগত সম্পর্কের’ দায়-দায়িত্বও তারা বহন করবে। এরই নাম বিয়ে। সামাজিক স্বীকৃতি নয়, বরং সমাজের সাধারণ অবগতিই হলো বিয়ের শর্ত।

অনুষ্ঠানের মাধ্যমে যা অর্জিত হয়। ইসলাম ধর্ম অনুসারে বিয়ের অনুষ্ঠানে শ্রেফ ৭জন লোক থাকাই যথেষ্ট। একজন কাজী, দু’জন অভিভাবক, দু’জন সাক্ষী এবং বর ও কনে। কেন বিয়েতে ৫-৭টা অনুষ্ঠান করতে হবে, কেন দফায় দফায় কয়েক শ’-হাজার লোক খাওয়াতে হবে, কেন সামর্থকে ছাড়িয়ে লাখ লাখ টাকা খরচ করতে হবে, তা আমার বুঝে আসে না। অনাবশ্যক এই সব সামাজিকতা কি কাউকে বেহেশতে নিবে? না করলে কি কেউ দোজখে যাবে? যারা এ’সব ফালতু আনুষ্ঠানিকতা করে নাই তারা কি সমাজচ্যূত হয়েছে?

আমি কোনো দিনই কোনো উপলক্ষ্যে এমন কি ৫০ জন লোককেও কখনো দাওয়াত করে খাওয়াই নাই। তাতে কী হয়েছে? আমি কি কম সামাজিক? দীর্ঘদিন আমি কোনো বিয়ের অনুষ্ঠানে যেতাম না। সংশ্লিষ্ট সবাই জানতো, বিয়ের বাহুল্য খরচকে অপছন্দ করার কারণে আমি বিয়ের অনুষ্ঠানে যাই না।

২০০৯ সালে আম্মা মারা যাওয়ার পরে গ্রামে যাওয়া শুরু করি। আত্মীয় স্বজনদেরকে চেনার জন্য এরপর থেকে বিয়েশাদির অনুষ্ঠানেও নিয়মিতভাবে যাই। অবশ্য গিয়ে যা দেখি তাতে করে ফিরে আসার পরে ভিতরে ভিতরে যথেষ্ট অনুশোচনাতে ভুগি।

১৯৯৪ সালের জানুয়ারীতে আমার বিয়ের সময়ে যদি আমাদের পক্ষ থেকে দাবী করা হতো, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে প্যাণ্ডেল টানিয়ে দশ হাজার মানুষকে ‘বৈরাত’ খাওয়াতে হবে, তাহলে আমার শ্বশুর তা-ই করতেন। তখনকার সময়ে পাত্র হিসাবে আমার ততটা ‘বাজার-মূল্য’ ছিলো।

সংশ্লিষ্টরা জানে, আমার শ্বশুর মাদারীপুর শহরে তখনকার সময়ে ছিলেন যথেষ্ট বিত্তশালী। নিজের অনাড়ম্বর বিয়ের উদাহরণ টানলাম এ জন্য যে, বিয়েতে বাহুল্য খরচ রোধ করার জন্য সবচেয়ে বেশি সুবিধাজনক পজিশনে থাকে স্বয়ং পাত্র ও পাত্রী। বিশেষ করে, এ ক্ষেত্রে পাত্রীর ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমার সংসারে শ্বশুড়বাড়ি হতে ‘উপহার’ হিসাবে পাওয়া কিছুই নাই।

কথা আর বেশি না বাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করতে চাই, আছে কি এমন কোনো সাহসী নারী যে বলবে, “নিজের বিয়েতে আমি এ ধরনের অতিসামাজিকতা ও বাহুল্য ব্যয়কে যথাসাধ্য রোধ করবো”? আছে কি এমন সৎ পুরুষ যে বলবে, “প্রকাশ্য বা গোপন কোনো ধরনের যৌতুক নেয়া ও বাহুল্য ব্যয় ছাড়াই আমি বিয়ে করবো”? এমন কঠিন ওয়াদা করতে তোমরা যারা অনাগ্রহী তারা সারাজীবন আদর্শ-আদর্শ খেলতে পারো, নীতি-নৈতিকতার কথা বলে মানসিক সান্তনা পেতে পারো, আন্দোলন-আন্দোলন জপতে পারো, বাস্তবতা হচ্ছে you are a worthless defender of stagnant status-co. Actually, you are one of them, against whom you are claiming to fight.

সাহসীদের বলছি, জেনে রাখো, এমন ধরনের আদর্শবাদীদের দিয়েই একটা সুন্দর সমাজ গড়া সম্ভব যারা নিজেরা আদর্শের দাবীকে অন্তত নিজেদের ব্যক্তি জীবনে অনুসরণ ও বাস্তবায়ন করে অন্যদের জন্য নিজেদেরকে উদাহরণ হিসাবে উপস্থাপন করতে পারে। লম্বা লম্বা কথা বলা বকোয়াজদের সাথে আমি নাই। বিয়ে হোক বাহুল্য ব্যয় বর্জিত সহজতর স্বাভাবিক সম্পর্কের ব্যাপার।

গোপন ও দায়দায়িত্বহীন সম্পর্ক যেমন অন্যায় ও প্রান্তিকতা, অনর্থক এত ঢাকঢোল পিটানো ব্যয়বহুল এসব বিয়ে অনুষ্ঠানও সম-পরিমাণের অন্যায় ও প্রান্তিকতা। এই দুষ্টচক্র হতে সমাজটাকে বের করে নিয়ে আসার জন্য সমাজকর্মীদের হতে হবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ।

সহযোগী অধ্যাপক,
দর্শন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়