banner

বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ইং, ,

Daily Archives: April 23, 2024

 

কেন বাচ্চারা শিক্ষকদের ভালবাসে?-আফরোজা হাসান

ছয়মাস ভলান্টিয়ার টিচার হিসেবে স্কুলে কাটানোর সময় গুলোতে অনেক কিছু নতুন করে শিখেছি আমি। তারমধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ একটি জিনিস হচ্ছে
images(37)
শিক্ষকের প্রতি ভালোবাসার প্রয়োজনীয়তা।
ইউরোপের স্কুলগুলোতে স্টুডেন্ট আর টিচারদের সম্পর্ক এতো সুন্দর আর বন্ধুত্বপুর্ণ যা নিজের স্কুল লাইফের দিকে তাকালে খুঁজে পাইনা। এখানকার টিচাররাও বাচ্চাদেরকের সাথে রাগ করেন, ওদেরকে বকাঝকা করেন, শাস্তি দেন। পার্থক্য শুধু পদ্ধতিতে।
img20171125_125115
শাস্তি দেবার সময় কেন শাস্তি দিচ্ছেন, শাস্তিটা কেন দেয়া উচিত, দেয়ার ফলে কি উপকার হবে এবং না দিলে কি ক্ষতি হতো এই প্রতিটা বিষয় চমৎকার করে বুঝিয়ে বলেন টিচাররা স্টুডেন্টদেরকে। যারফলে বাচ্চাদের মনে টিচারদের প্রতি কোন ক্ষোভের সৃষ্টি হতে পারে না এবং শাস্তির কারণ এবং উপকারিতা ও অপকারিতা জানার ফলে নিজেকে সংশোধন করাটাও সহজ হয়।
img20171125_124745
একদিন ক্লাসে একটা বাচ্চার হঠাৎ পেট ব্যথা শুরু হলে সে মেঝেতে শুয়ে ছটফট করতে লাগলো। স্বভাবতই কিছু বাচ্চার হাসির খোড়াক যোগালো দৃশ্যটি, কিছু বাচ্চা প্রশ্ন করলো ও কি এখন মারা যাবে? কয়েকজন ছুটে এলো বন্ধুর পাশে আর কয়েকজন নির্বিকার বলে রইলো নিজের সীটে।
img20171125_124845
বাচ্চাটি সুস্থ হবার পর প্রফেসর বললেন যে কয়জন সাহায্যর জন্য ছুটে এসেছিলো তারা ছাড়া বাকি সবার আজকে টিফিন বন্ধ। কেউ টিফিন পিরিয়ডে পার্কে যেতে পারবে না। বাচ্চারা সবাই তখন চিৎকার করে বলল, আমরা তো কিছুই করিনি প্রফে তাহলে কেন আমাদেরকে শাস্তি দিচ্ছো?
img20171125_125224
প্রফেসর বললেন, তোমাদের অন্যায় তোমরা তোমাদের বন্ধুর বিপদে ছুটে আসোনি, তার কষ্টে সমব্যথী না হয়ে হেসেছো, সান্ত্বনা বা আশ্বাস দেবার বদলে মারা যাবে বলে ওকে আরো ঘাবড়ে দিয়েছো। একবার ওর জায়গায় নিজেকে চিন্তা করে দেখো তো। তুমি কষ্টে ছটফট করছো আর কেউ তোমার দিকে তাকিয়ে হাসছে, কেন এতো ব্যথা করছে তুমি ভেবে পাচ্ছো না আর পাশ থেকে একজন বলছে তুমি এখন মারা যাবে। বাচ্চারা তখন চুপ হয়ে গেলো।
img20171125_125323
যারা সীটে বসে ছিল তাদের একজন বলল, আমরা তো কিছুই করিনি প্রফে। আমরা তো চুপ করে বসে ছিলাম।
প্রফেসর বললেন, অন্যের কষ্ট, বিপদ দেখে তোমাদের মনে এতটুকু দয়া-মায়ার সৃষ্টি হয়নি এটা তো সবচেয়ে বড় অন্যায়। মনেরেখো তুমি অন্যের সাথে যে আচরণ করবে তোমার সাথেও অন্যেরা সেই আচরণই করবে। আজ তুমি অন্যের কষ্ট দেখে হাসলে, কাল তোমার কষ্টে অন্যেরা হাসবে। আজ তুমি কাউকে সাহায্য করতে কার্পন্য করলে, কাল তোমার বিপদে কাউকে খুঁজে পাবে না পাশে। এখানে তোমরা সবাই বন্ধু। একসাথে পড়বে, খেলবে, হাসবে, একের বিপদে অন্য সাহায্য করবে। আর যদি এমন না করো তাহলে কখনোই তোমরা ভালো মানুষ হতে পারবে না জীবনে।
img20171125_124715
এখন বলো তোমরা কি ভুল করেছো? সবাই স্বীকার করে নিলো যে তারা ভুল করেছে। প্রফেসর বললেন, এখন যদি আমি তোমাদেরকে শাস্তি না দেই তাহলে তোমরা এই ভুলটা মনেরাখতে পারবে না এবং আবারো যখন এমন কোন পরিস্থিতি আসবে একই ভুল করবে। বাচ্চারা তখন খুশি মনে ওদের শাস্তি মেনে নিয়েছিলো।
img20171125_124910
এমন অনেক বাচ্চা আছে যারা বাবা-মা বা পরিবারের কারো কোন কথা শোনে না কিন্তু সেই কথাটা যদি স্কুলের টিচাররা করতে বলে তাহলে বিনা ঝামেলাতে করতে রাজী হয়ে যায়। আগে আমি বেশ অবাক হতাম এর কারণ কি হতে পারে চিন্তা করে। কিন্তু স্কুলে জয়েন করার পর বুঝেছি কেন বাচ্চারা এতো পাগল টিচারদের জন্য। কেন এতো ভালোবাসে টিচারদেরকে। কারণ উনারা সেই ভালোবাসা অর্জন করে নেন তাদের কথা, কাজ আর আচরণের দ্বারা।
img20171125_125000
টিচিং কোর্স করার সময় আমাদেরকে বলা হয়েছিলো টিচারদের প্রতি ভালোবাসা বাচ্চাদেরকে অনেক বেশী উৎসাহিত করতে পারে পড়াশোনার প্রতি। বাচ্চাদের মনে যদি এই বিশ্বাস তৈরি করা যায় যে টিচাররা তাদেরকে ভালোবাসেন আর তাদের ভালো চান বলেই প্রয়োজনে তাদেরকে বকা দেন আর শাস্তি দেন এবং এরফলে উপকার তাদেরই হয় তাহলে স্কুল ও পড়াশোনার প্রতি বাচ্চাদের আগ্রহ অনেক বেশি থাকে।
এই চমৎকার আইডিয়াটা কিন্তু পারিবারিক জীবনেও এপ্লাই করা যায়। বাচ্চার মনে যদি বাবা-মা আর পরিবারের লোকজন এই বিশ্বাস ও ভরসা তৈরি করতে পারেন যে, তারা যা বলেন তাদের উপকার ও মঙ্গলের জন্যই বলেন তাহলে বাচ্চাদের মনে অকারণ রাগ, ক্ষোভ বা হতাশা সৃষ্টির সুযোগ অনেক কমে যায়। বাবা-মা যা করছেন আমার ভালো জন্য করছেন এবং আমার প্রতি ভালোবাসা থেকেই করছেন বাচ্চার মনে এই নিশ্চয়তা সৃষ্টির দায়িত্ব বাবা-মাকেই পালন করতে হবে। কথা, কাজ ও আচরণ দিয়ে বাচ্চার কাছে নিজেদেরকে কল্যাণকামী হিসেবে গ্রহণযোগ্য করে গড়ে তুলতে হবে।

 

নাতীর সাথে পিইসি পরীক্ষা দিলেন নানী -নাজমুস সাকিব

শিক্ষার কোনো বয়স নেই, সাউথকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) পরীক্ষায় নাতির সাথে অংশগ্রহণ করে একথা বাস্তবে প্রমাণ করলেন ময়মনসিংহের ত্রিশালের ৬৫ বছর বয়সী সুন্দরী বেগম।
এ বছর উপজেলার হরিরামপুর ইউনিয়নের সাউথকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পিএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী ২৮ শিক্ষার্থীর মধ্যে সুন্দরী বেগমও অংশগ্রহণ করেছেন। হরিরামপুর ইউনিয়নের সাউথকান্দা গ্রামের বর্গাচাষি আবুল হোসেনের স্ত্রী সুন্দরী বেগম। ওই দম্পতির চার ছেলে এক মেয়ের মধ্যে একজন সৌদি প্রবাসী, দু’জন ভ্যানচালক ও তৃতীয় ছেলে সাইদুল ইসলামকে কষ্ট করে এইচএসসি পাস করিয়েছেন। ছয় বছর আগে সুন্দরী বেগমের ছেলেদের উপার্জনের টাকা জমা রাখতে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক কাশিগঞ্জ শাখায় অ্যাকাউন্ট খুলতে যান। নিরক্ষর সুন্দরী বেগম কোনো রকম স্বাক্ষর শিখেছিলেন। তিনটি স্বাক্ষরের মধ্যে একটি স্বাক্ষর ভুল হওয়ায় ব্যাংকের ব্যবস্থাপক ফাইলটি সুন্দরী বেগমের মুখে ছুড়ে মারেন। কেঁদে কেঁদে বাড়ি ফিরে তিনি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেন যেকোনো মূল্যে নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে তিনি বেড়িয়ে আসবেন।
পরের দিন একমাত্র মেয়ে রহিমার তৃতীয় সন্তান জিহাদকে নিয়ে সাউথকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে প্রধান শিক্ষকের সাথে কথা বলে ভর্তি হন প্রথম শ্রেণীতে। ধাইয়ের কাজের পাশাপাশি প্রতিদিন স্কুলে কাস করতেন। ছয় বছর পরিশ্রমের পর এ বছর তিনি নাতি জায়েদ ও দেবরের ছেলে মুহিবের সাথে পিএসসি পরীক্ষায় অংশ নিলেন।
সোমবার বাংলা পরীক্ষা চলাকালে দুপুর ১২টার দিকে চাউলাদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরীক্ষা কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, ওই কেন্দ্রের ৩৭০ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ৬৫ বছর বয়সী সুন্দরী বেগমও মনযোগ সহকারে লেখায় ব্যস্ত রয়েছেন। পরীক্ষা শেষে সুন্দরী বেগম প্রতিবেদককে জানান, কৃষি ব্যাংকের ব্যবস্থাপকের দুর্ব্যবহারে নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে প্রতিজ্ঞা করে আমি স্কুলে ভর্তি হয়েছি। জন্মেছিলাম দরিদ্র পরিবারে, লেখাপড়া তো দূরের কথা ভরণ-পোষণ ঠিকভাবে দিতে পারেনি পরিবার। খুব অল্প বয়সে বিয়ে হয় আরেক দরিদ্র পরিবারে। দরিদ্র হওয়ায় সন্তানদেরও পড়াশুনা করাতে পারিনি। তিনি আরো বলেন, গত ছয় বছরে সব কাস পরীক্ষায় নাতির বয়সী সব শিক্ষার্থী-শিক্ষকের অনেক উৎসাহ ও সহযোগিতা পেয়েছি। প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিয়ে খুব ভালো লাগছে।
সাউথকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুস সালাম জানান, এ বয়সে লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করে সুন্দরী বেগম নিরক্ষরতার অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বেড়িয়ে আসার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
পরীক্ষা কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, শিক্ষার কোনো বয়স নেই, এটাই প্রমাণ করলেন সুন্দরী বেগম। তাকে আমি স্যালুট জানাই। অজ্ঞতা থেকে ফিরে আসুক সবাই।
চাউলাদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও পরীক্ষা কেন্দ্র সচিব বদর উদ্দিন জানান, আমার শিক্ষকতা জীবনে এমন বিরল দৃষ্টান্ত আর দেখিনি।

সুত্রঃ নাজমুস সাকিব ত্রিশাল (ময়মনসিংহ), নয়াদিগন্ত