banner

শুক্রবার, ০২ মে ২০২৫ ইং, ,

Daily Archives: May 1, 2025

 

স্বীকৃতির আনন্দ ম্লান

স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর সরকার বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকজনকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়েছে। সরকারের গেজেট তালিকা অনুযায়ী, সারা দেশে প্রথম দফায় ৪১ জনের মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ১১ জন রয়েছে। কিন্তু গত সাড়ে পাঁচ মাসেও কোনো অনুদান, ভাতা বা সম্মানী তাঁরা পাননি। ফলে স্বীকৃতি পেয়ে যে আনন্দ তাঁরা পেয়েছিলেন, অব্যাহত কষ্টে তা ম্লান হয়ে যাচ্ছে।
বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে জেলার গোমস্তাপুর উপজেলার বোয়ালিয়া ইউনিয়নের রাবিয়া বেগম, হাসনা বেগম, জলো বেগম, সফেদা বেগম, আয়েশা বেগম, রেনু বেগম, হাজেরা বেগম, আরবী বেগম, রাহেলা বেগমসহ সদরের লিলি বেগম ও শিবগঞ্জের মালেকা বেগম স্বীকৃতি পেয়েছেন। এই বীরাঙ্গনাদের মধ্যে ৯ জনই বোয়ালিয়া ইউনিয়নের।
এ ইউনিয়নের নরশিয়া, চকমজুমদার ও সাহাপুরে পাকিস্তানি বাহিনী এবং রাজাকাররা হত্যা, বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া ও সম্ভ্রমহানির ঘটনা ঘটায় বেশি। এ এলাকায় সম্ভ্রম হারানোর সংখ্যা কয়েক শ। অনেকে লজ্জায় ভয়ে মুখ খোলেনি আজও।
গত বছরের ১২ অক্টোবর সরকার এ-সংক্রান্ত গেজেট তালিকাটি প্রকাশ করে। গত মঙ্গলবার সরেজমিনে গেলে হাজেরা বেওয়ার সন্তান কেতাউর রহমান ও রাবেয়া বেওয়ার সন্তান নাসিম বলেন, ‘গত বিজয় দিবসে জেলা প্রশাসক আমাদের মাসহ বোয়ালিয়ার সাত বীরাঙ্গনা মাকে একটি করে শাড়ি, একটি তোয়ালে ও একটি চাদর দিয়েছিলেন। ঘর করার জন্য টিন দিতে চেয়েছিলেন। তাঁদের পরামর্শে স্থানীয় সোনালী ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। কোনো টাকা আসেনি ব্যাংকে, টিনও পাননি কেউ।’
তাঁরা জানান, বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে পরের জমিতে কোনো মতে খুপরি চালা তুলে বসবাস করছেন। তাঁদের সংসার চলে জমিতে ধান কুড়িয়ে, ঝিয়ের কাজ ও ভিক্ষা করে। কেউ কেউ দিন যাপন ও বাস করছেন ছেলে-মেয়ে বা মেয়ে জামাইয়ের দয়ায়। বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা হাসনা বেওয়ার ভিক্ষা করে সংসার চলে। বাড়ি করার জন্য দ্রুত জমি, টিন ও ভাতা দেওয়ার জোর দাবি জানান তিনি।
মালেকা বেগমের সাত সন্তান। কিন্তু থাকেন ননদের জমিতে খুপরি চালায়। ছেলেরা দেখে না। তাই চেয়েচিন্তে চলে চার মেয়ে ও তাঁর। এক টুকরা জায়গা ও একটি ঘরের দাবি তাঁর। রাহেলা বেগমের এক ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলের নিজ সংসারেই টানাটানি। মাকে দিতে পারেন না খরচ। তাই মেয়ে ও পরের বাড়িতে কাজ করে ও ধান কুড়িয়ে চলে সংসার। বোয়ালিয়া এলাকায় একাত্তরের ২২ নভেম্বর ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বেনজির আহমেদ বলেন, ‘স্থানীয় রহনপুরে এবি উচ্চ বিদ্যালয়ে স্থাপিত পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারদের ক্যাম্প ছিল। তারা নরশিয়া, চকমজুমদার ও সাহাপুর এলাকায় নেমে ১৭ মুক্তিযোদ্ধা ও ১৮ জন নিরীহ মানুষকে গুলি চালিয়ে হত্যা করে। বহু নারীর সম্ভ্রমহানি করে তারা, যা আজও ভুলতে পারেননি সম্ভ্রম হারানো ও শহীদদের স্বজনরা।’
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘অস্ত্রহাতে যুদ্ধ না করলেও এসব বীরাঙ্গনা আমাদের মতোই বীর। লোকলজ্জা আর ধর্মীয় গোঁড়ামির শিকার এসব নারী মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক।’ এ বিষয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমি নতুন এসেছি। আপনার মাধ্যমে জানলাম, তাঁদের আশ্বস্ত করা টিন দেওয়া হয়নি। এক সপ্তাহের মধ্যে এসব বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধার জন্য টিন পৌঁছে দেওয়া হবে। ভাতা পাওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে লিখিতভাবে জানানো হবে।’

 

সোহাগী জাহান হত্যাকাণ্ড, তদন্তে অগ্রগতি নেই, পরিবারকে জেরা

কুমিল্লা সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজের ইতিহাস দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ও নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান (তনু) হত্যাকাণ্ডের তদন্তে দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। শুক্রবার রাতে ও গতকাল শনিবার দুপুরে সোহাগীর পরিবারের সদস্যদের বাড়ি থেকে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন র্যাব ও পুলিশের সদস্যরা।
হত্যার বিচার চেয়ে গতকাল শনিবারও ছাত্র-জনতা কুমিল্লা নগরীর কান্দিরপাড় এলাকায় বিক্ষোভ করেছে। প্রতিবাদ-বিক্ষোভ অব্যাহত আছে রাজধানীসহ দেশের কয়েকটি স্থানে।
২০ মার্চ রাত সাড়ে ১০টায় কুমিল্লা সেনানিবাসের পাহাড় হাউস এলাকায় সোহাগ ী জাহানের লাশ পাওয়া যায়। এ ঘটনার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তোলপাড় শুরু হয়। নিহত শিক্ষার্থীর বাবা ইয়ার হোসেন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের নামে কোতোয়ালি মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। হত্যা মামলাটি শুক্রবার পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) কাছে হস্তান্তর করা হয়।
তদন্তের অগ্রগতি বিষয়ে জানতে চাইলে কুমিল্লা জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) মো. শাহ আবিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সুনির্দিষ্টভাবে বলার মতো কোনো অগ্রগতি নেই। সংরক্ষিত এলাকায় কিছু আইনগত বিধিনিষেধ থাকে। বলছি না যে আমরা সহযোগিতা পাচ্ছি না। তবে তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের অন্যের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে।’
সোহাগী হত্যার বিচারের আশ্বাস দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, ‘আমরা অনেক বড় বড় ঘটনার রহস্য বের করেছি। এটিরও রহস্য উদ্ঘাটন হবে। হয়তো একটু সময় লাগছে। এ ঘটনায় শিগগিরই সুখবর দেওয়ার আশা প্রকাশ করেছেন র্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ।’
শুক্রবার বিকেলে কুমিল্লার মুরাদনগরের মির্জাপুরে গ্রামের বাড়িতে অবস্থানরত সোহাগীর বাবা মো. ইয়ার হোসেন ও বড় ভাই নাজমুল হোসেনকে ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের কর্মকর্তারা নিয়ে যান। রাত সাড়ে ১২টার দিকে সোহাগীর মা আনোয়ারা বেগম, ভাই আনোয়ার হোসেন ও চাচাতো বোন লাইজু আক্তারকে র্যাব-১১-এর একটি দল কুমিল্লার শাকতলা কার্যালয়ে নিয়ে যায়।
গতকাল সকালে মুরাদনগরের মির্জাপুরে সোহাগীর চাচা আলাল হোসেন এসব তথ্য জানান। এ সময় তাঁদের প্রতিবেশী মো. হুমায়ূন কবীর বলেন, গভীর রাতে র্যাব আসায় পরিবারের সদস্যরা ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। তাই প্রতিবেশী দুজনও তাঁদের সঙ্গে যান।
রাতে র্যাব কার্যালয়ে তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নেওয়া হয়েছিল বলে প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছেন র্যাব-১১ কুমিল্লার অধিনায়ক মো. খুরশীদ আলম।
গতকাল দুপুরে সোহাগীর পরিবারের সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন ডিবির সদস্যরা। ক্যান্টনমেন্টের বাসা থেকে কোতোয়ালি থানায় নিয়ে তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
জিজ্ঞাসাবাদের পর সোহাগীর পরিবারের সদস্যরা এখন ক্যান্টনমেন্টের বাসায় রয়েছেন।
সোহাগী হত্যার তদন্ত সব বাহিনীর সমন্বয়ে হচ্ছে, নাকি আলাদা আলাদাভাবে বাহিনীগুলো করছে—এ সম্পর্কে পরিষ্কার কোনো তথ্য মেলেনি। জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক মো. হাসানুজ্জামান কল্লোল প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুলিশ মামলাটি তদন্ত করছে। র্যাব কেন তাদের বাড়ি থেকে তুলে এনেছে আমি জানি না। খোঁজ নিয়ে বলতে হবে।’
কুমিল্লায় প্রতিবাদ অব্যাহত: হত্যার বিচার চেয়ে গতকালও ছাত্র-জনতা নগরীর কান্দিরপাড় এলাকায় বিক্ষোভ করেছে। এ সময় তারা ‘একাত্তরের বিচার হচ্ছে ৪০ বছর পর, তনু হত্যার বিচার পাব কত বছর পর?’ ‘আপনি দেখে চলে যাবেন, কারণ তনু আপনার বোন না’ ইত্যাদি লেখা প্লাকার্ড বহন করছিল।
হত্যার বিচার চেয়ে আজ রোববার সকাল ১০টায় নগরের কান্দিরপাড় থেকে মিছিল করে পদুয়ার বাজার ও আলেখার চর এলাকার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে সোহাগীর সহপাঠীরা। বেলা তিনটায় গণজাগরণ মঞ্চের উদ্যোগে কান্দিরপাড় পূবালী চত্বরে প্রতিবাদ সমাবেশ হওয়ার কথা রয়েছে। এর আগে গত মঙ্গলবার আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও নাট্যকর্মীরা সোহাগীর হত্যাকারীদের খুঁজে বের করতে ৭২ ঘণ্টা সময় বেঁধে দিয়েছিল। সে সময় পেরিয়ে গেছে গত শুক্রবার।
আরও প্রতিবাদ: সোহাগী হত্যার বিচারের দাবিতে রাজধানীর উত্তরায় হাউস বিল্ডিংয়ের সামনের সড়কে মানববন্ধন করে স্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। ‘আমরা সবাই তনুর ভাই, তনু হত্যার বিচার চাই’ স্লোগান দিয়ে বিচারের দাবি করে শিক্ষার্থীরা। ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও নীলফামারীর সৈয়দপুরেও মানববন্ধন হয়েছে।
লন্ডন প্রতিনিধি জানান, এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে গত শুক্রবার স্থানীয় সময় সন্ধ্যায় পূর্ব লন্ডনের একটি রেস্তোরাঁয় প্রতিবাদ সভা করেছে যুক্তরাজ্যে বসবাসরত কুমিল্লাবাসীর সংগঠন গ্রেটার কুমিল্লা অ্যালায়েন্স। সভায় বক্তারা এই হত্যার রহস্য উন্মোচন করে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করেন। সংগঠনের সভাপতি সাইফুল ইসলামের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ আহমেদের পরিচালনায় সভায় বক্তব্য দেন নুরুল আলম, লেয়াকত আলী, সংস্কৃতিকর্মী স্মৃতি আজাদ প্রমুখ।
আসকের নিন্দা ও উদ্বেগ: সোহাগী হত্যায় এখন পর্যন্ত কোনো অপরাধী গ্রেপ্তার না হওয়ায় নিন্দা ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। গতকাল এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আসক বলেছে, সেনানিবাসের মতো নিরাপত্তাবেষ্টিত এলাকায় এ ধরনের নৃশংস ঘটনা এবং ঘটনার সঙ্গে জড়িত কাউকে আইনের আওতায় আনতে না পারা জনমনে নানা প্রশ্ন ও ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। সংগঠনটি অবিলম্বে দোষী ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক বিচার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল পদক্ষেপ নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।