banner

মঙ্গলবার, ১৭ Jun ২০২৫ ইং, ,

পোস্টটি 30 বার পঠিত

 

রোমেনা আফাজ: বাংলা সাহিত্যের এক সাহসিনী কিংবদন্তি

বাংলা সাহিত্যে যখন নারী লেখকদের উপস্থিতি ছিল হাতে গোনা, তখনই একজন নারী কলম ধরেছিলেন অপরাধ ও অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি লেখার সাহস দেখিয়ে। তিনি হলেন রোমেনা আফাজ—‘দস্যু বনহুর’ সিরিজের স্রষ্টা। ষাট ও সত্তরের দশকে যাঁদের ‘আউট বই’ পড়ার অভ্যাস ছিল, তাঁদের শৈশবে রোমাঞ্চ জুগিয়েছেন এই লেখিকা। অথচ সেই লেখিকা আজ প্রায় বিস্মৃত।

রোমেনা আফাজ জন্মগ্রহণ করেন ১৯২৬ সালের ২৭ ডিসেম্বর, বগুড়ার শেরপুর উপজেলায়। তাঁর বাবার নাম কাজেম উদ্দিন ও মায়ের নাম আছিয়া খাতুন। বাবা ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের কলকাতা শহরের একজন পুলিশ পরিদর্শক। সেই পেশাগত জীবনের গল্প শুনে ছোটবেলা থেকেই রোমেনার মধ্যে অপরাধ ও থ্রিলারের প্রতি আগ্রহ জন্মায়।

মাত্র ৯ বছর বয়সে ‘বাংলার চাষী’ নামে একটি ছড়া প্রকাশিত হয় কলকাতার জনপ্রিয় পত্রিকা ‘মোহাম্মদী’তে। এটিই ছিল তাঁর ছাপা হওয়া প্রথম লেখা।

মাত্র ১৩ বছর বয়সে রোমেনা বিয়ে করেন বগুড়ার ফুলকোর্ট গ্রামের চিকিৎসক আফাজ উল্লাহকে। বিয়ের পর তাঁর নাম হয় রোমেনা আফাজ—যে নামে তিনি পরিচিত হন সারাজীবন।

পরবর্তীতে ১৯৬০ সালের দিকে তাঁরা বসবাস শুরু করেন বগুড়া শহরের জলেশ্বরীতলায়, যেখানে রোমেনা আফাজের সাহিত্যিক জীবনের মূল ভিত্তি গড়ে ওঠে।

লেখালেখিতে তাঁর পেশাদার যাত্রা শুরু হয় ১৯৫৯ সালে। সেই বছর ‘সাহিত্য কুঠির’ নামের এক স্থানীয় প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম বই—‘রক্তে আঁকা ম্যাপ’। এটি ছিল একটি নারী চরিত্রকেন্দ্রিক অ্যাডভেঞ্চার লসিরিজ ‘দস্যুরানী’-এর সূচনা।

এরপর ১৯৬৫ সালে তিনি শুরু করেন তাঁর বিখ্যাত ‘দস্যু বনহুর’ সিরিজ। এই সিরিজের বই সংখ্যা ১৩৮টি, যা একক নারীনামধারী লেখকের পক্ষে এক বিরল কীর্তি।

যেখানে কাজী আনোয়ার হোসেনের ‘মাসুদ রানা’ ছিল সাহসী গোয়েন্দা, সেখানে রোমেনা আফাজের ‘দস্যু বনহুর’ ছিল সাহসী, চৌকস এক ডাকাত, যার দস্যুবৃত্তির আড়ালে ছিল ন্যায়বোধ ও রোমাঞ্চ। তাঁর লেখা সহজ ভাষায়, টানটান উত্তেজনাময় প্লটে ভরপুর—যা সাধারণ পাঠকদের কাছে ছিল সহজবোধ্য ও আকর্ষণীয়।

রোমেনা আফাজের উপন্যাসের কাহিনি কেবল বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ থাকেনি। তাঁর লেখা অবলম্বনে ছয়টি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়।

রোমেনা আফাজ ছিলেন কাজেম-আছিয়া দম্পতির বড় সন্তান।
তিনি সাত পুত্র ও দুই কন্যা সন্তানের জননী। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন সন্তানের মৃত্যু ঘটে আগেই। যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁদের কেউ বগুড়ায়, কেউ প্রবাসে বসবাস করছেন। ছোট ছেলে মন্তেজার রহমান আঞ্জু বর্তমানে বগুড়া শহরে থাকেন।

নাতনি উম্মে ফাতেমা লিসার উদ্যোগে জলেশ্বরীতলার বাড়িকে ‘রোমেনা আফাজ স্মৃতিঘর’ হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছিল। পরবর্তীতে তা স্থানান্তরিত হয় শহরের আলতাফুনেছা খেলার মাঠসংলগ্ন একটি ক্লাবে।

সাহিত্যে তাঁর অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে রোমেনা আফাজ জীবদ্দশায় পেয়েছেন ২৭টি পুরস্কার ও সম্মাননা এবং মৃত্যুর পরে ২০১০ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ‘স্বাধীনতা পুরস্কারে’ ভূষিত করে—যা দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা।

বগুড়া পৌরসভা তাঁর সম্মানে তাঁর বাড়ির সামনের সড়কটির নামকরণ করে ‘রোমেনা আফাজ সড়ক’ হিসেবে।

২০০৩ সালের ১২ জুন, ৭৭ বছর বয়সে বগুড়ার জলেশ্বরীতলার নিজ বাসভবনে রোমেনা আফাজ মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পর সেই বাড়িটি ফাঁকা পড়ে আছে—যেন এক সময় সাহিত্যে ঝড় তোলা এক নারীচরিত্র আজ নিঃশব্দে বিশ্রামে।

রোমেনা আফাজ ছিলেন সাহিত্যে নারীর সাহসী পথচলার প্রতীক। একাই লিখে গেছেন দুই শতাধিক বই—উপন্যাস, ছোটগল্প, কবিতা, সিরিজ—সব মিলিয়ে তাঁর সাহিত্যভাণ্ডার বিস্ময়কর।
তিনি প্রমাণ করেছিলেন, থ্রিলার বা অ্যাডভেঞ্চার শুধু পুরুষ লেখকদের ক্ষেত্র নয়-নারীর কলমও পারে পাঠককে শ্বাসরুদ্ধকর উত্তেজনায় বেঁধে রাখতে।

আজ যখন সাহিত্যজগতে নারীর অংশগ্রহণ নিয়ে আলোচনা হয়, তখন রোমেনা আফাজকে স্মরণ করা আমাদের সাংস্কৃতিক দায়িত্ব। তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্যের অলিখিত রাণী—যাঁর সৃষ্ট দস্যু বনহুর, আজও পাঠকের মনে চিরজাগরুক।

Facebook Comments