banner

শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 480 বার পঠিত

ব্যবসায়ী হতে হলে প্রয়োজন নিজের ওপর আস্থা ও সাহস : কানিজ ফাতেমা

14363_nari-1অপরাজিতাবিডি ডেস্ক: বাণিজ্যমেলার প্রধান ফটক পার হয়ে রুপালি রঙের আলো ঝলমলে তারার দেশের মতো ২ নম্বর প্যাভিলিয়নের কাছে যেতেই চোখ দুটো যেন স্থির হয়ে রইল নানা ধরনের তৈজসপত্র, বাসন-কোসন, গ্লাস-বাটিসহ দুই শতাধিক স্টেনলেস স্টিলের খুবই টেকসই ও চমৎকার ঝকঝকে পণ্য দেখে, যা তৈরি হয়েছে বাংলাদেশী কারখানায়।

 

এতে ব্যবহার করা হচ্ছে বিদেশী প্রযুক্তি ও কাঁচামাল। পুরো প্যাভিলিয়ন সাজানো হয়েছে A-1 Max (Stainless Steel Products)-এর উৎপাদিত পণ্য দিয়ে। আমার বিশ্বাস, এই শোরুমের দিকে কারো চোখ পড়লে কোনো শৌখিন গৃহিণী কেনাকাটা না করে ফিরতে পারবেন না। এত সুন্দর তৈজসপত্র ও ক্রোকারিজ দেখলে মনে হবে রুপালি তারার দেশে বেড়াতে এসেছি। সেই চোখধাঁধানো রূপে আকৃষ্ট হয়ে আমারও পরিচয় হয়েছিল এই কোম্পানির স্বত্বাধিকারী কানিজ ফাতেমা আইভির সাথে। তার এ উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার কথা জানতে সময় নিয়ে যাই তার বাসায়।

 

শীতের এক পড়ন্ত বিকেলে যখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। চার দিক সুমসাম অন্ধকার। দিন শেষে সব পাখি নীড়েও ফিরেছে। এমন সময় গিয়ে হাজির হয়েছিলাম কানিজ ফাতেমার বাসায়। প্রশস্ত সাজানো গোছানো পরিপাটি এক ড্রইংরুমে শুরু হলো কানিজ ফাতেমার সাথে আলাপ। ঘরের ইন্টিরিয়র ডিজাইন, কাঠের কারুকার্যময় ঘরের সিলিং, দেয়াল, শোকেসে সাজানো প্রতিটি শো-পিসে যেন শিল্পের অপূর্ব ছোঁয়ায় মন ভরে যায়। কানিজ ফাতেমা একজন সফল উদ্যোক্তা, স্নেহময়ী মা। যিনি একজন সাধারণ আটপৌরে গৃহিণী থেকে আজকের দিনের সফল উদ্যোক্তা হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। তিনি বহুল পরিচিত Max গ্রুপের ডিরেক্টর। বাবা মরহুম আতিকুর রহমান ছিলেন একজন সফল (লুব্রিকেটিং অয়েল) তেল ব্যবসায়ী। বাবার জ্যেষ্ঠ মেয়েকে তিনি মা ফাতেমা বলেই ডাকতেন।

 

কারণ কানিজ ফাতেমা জন্মের পর থেকেই বাবার ব্যবসায়ের উত্তরোত্তর উন্নতি হচ্ছিল, দিনে দিনে বাড়ছিল তার ব্যবসায়ের পরিধি। ছোট্টবেলা থেকেই ছিলেন অত্যন্ত সংযমী এবং পড়াশোনায়  মনোযোগী। সানফ্রান্সিস জেভিয়ার্স স্কুলে পড়াশোনা করেন। পরে বাংলাবাজার সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। কানিজ ফাতেমা আইভির দাদা মরহুম মৌলভী মো: মোখলেছুর রহমান ছিলেন তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের প্রভোস্ট এবং ডাবল গোল্ড মেডেলিস্ট। তারই একমাত্র সন্তান কানিজ ফাতেমার বাবা ব্যবসায়ী আতিকুর রহমান। তাই বাবাকে অনুসরণ করে কানিজ ফাতেমার মনের ভেতর ব্যবসায়ী হওয়ার বীজ অঙ্কুরিত হতে থাকে ছোট বেলাই। বদরুননেছা সরকারি মহিলা কলেজের প্রথম বর্ষে পড়তে পড়তেই সুশ্রী কানিজ ফাতেমার বিয়ে হয়ে যায় ১৯৮৩ সালে বুয়েট থেকে পাস করা ইঞ্জিনিয়ার গোলাম মোহাম্মদ আলমগীরের সাথে। বিয়ের পর স্বামীর সংসার আর সন্তান সামলাতে স্বামীর চাকরিস্থল আবুধাবিতে চলে যাওয়া আবার দেশে ফিরে আসা এমনই টানাপড়েনে পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া সম্ভভ হয়নি। তাই শেষমেশ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে ইসলামি হিস্ট্রিতে অনার্স মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। সাথে সাথে চালিয়ে যান ছেলেমেয়ের পড়াশোনা, স্কুল, কোচিং।  সন্তান একটু বড় হতে তিনি উদ্যোগি হন নিজের স্বপ্ন পুরুণ। ব্যবসা শুরু করার জন্যই তিনি স্বামীর অফিসে নিয়মিত যাওয়া শুরু করলেন। বুঝতে থাকলেন ব্যবসায়ের নানা পলিসি।

 

কাজ করতে করতে তিনি ভাবলেন একটি ডেভেলপিং ফার্ম দিলে কেমন হয়? যেহেতু তার স্বপ্ন ছিল স্থপিত হওয়ার, তাই তিনি ২০০৫ সালে শুরু করলেন একদম নিজস্ব উদ্যোগে Max Building Technologies Ltd. এ ফার্মের সব কাজ, প্লানিং কাইন্টের সাথে কথা বলা, সব কিছুই তিনি তদারকি করেন এবং ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবেও তিনি আছেন। স্বামীর আরো পাঁচটি আলাদা কোম্পানি আছে। তিনি পুরো Max  গ্রুপের চেয়ারম্যান। তার কোম্পানিগুলো হচ্ছেÑ i. Max Auto Mobile Products Ltd. ii. Max Industries Ltd. iii. Max Prestress Ltd. iv. Max Power Ltd. v. Lub House Industries Ltd. Oscar Trade Syndicate. এসব কোম্পানির ডিরেক্টর হিসেবে কানিজ ফাতেমা অফিসিয়াল কাজগুলো দেখাশোনা করেন। এ ছাড়া পুরো ম্যাক্স গ্রুপের মানবসম্পদ বিভাগ (HR) দেখাশোনা করেন তারই ছোট বোন কানিজ সালেহা আইলিপ ও ছোট ভাইয়ের বউ মমতাজ আরা। সাত বছর আগে তিনি Max Industreis Ltd.-এর একটি ব্র্যান্ড A-1 Max (Stainless Steel Products) এ ক্রোকারিজ ও স্টেনলেস স্টিলের বিভিন্ন সামগ্রী বাজারে ছাড়েন। Max A-1 ব্র্যান্ডকে দেশ-বিদেশের ক্রেতাদের কাছে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য এবারই বাণিজ্যমেলায় প্রথমবারের মতো স্টোল দেন।

 

তা ছাড়া ফাতেমার দুই ভাইও Max  গ্রুপের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত। বাবা মরহুম আতিকুর রহমানও একসময় Max গ্রুপের সাথে জড়িয়ে পড়েন। তিনি Max গ্রুপের সাবেক চেয়ারম্যান ছিলেন।

 

গত বছর বাবা ইহধাম ত্যাগ করেছেন। পারিবারিক সম্পর্কের এই বিশ্বাসের দৃঢ়তায় Max এগিয়ে যাচ্ছে স্বপ্নপ্রতিভায়। বর্তমানে এর স্থায়ী শ্রমিক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী আট হাজার থেকে নয় হাজার। প্রজেক্ট চলাকালে অস্থায়ী ছয়-সাত হাজার শ্রমিক বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করেন। বিপুল এই শ্রমিকের দেখভাল, অভাব-অভিযোগসহ তাদের খোঁজখবর নেয়া কানিজ ফাতেমার প্রধান কাজের মধ্যে পড়ে।

 

কানিজ ফাতেমা কথা প্রসঙ্গে জানালেন সারা জীবন তিনি স্বামীর সাথে অর্ধশতাধিক দেশে ঘুরেছেন। তাই আট-নয় বছর ধরে ঈদে বা বড় কোনো ছুটিতে সপরিবারে অর্থাৎ মা-ভাই-বোনসহ ২৫-৩০ জন মিলে ওমরাহ পালন করতে মক্কায় যান। চার-পাঁচ বছর ধরে শ্রমিকদের বৃদ্ধ বাবা-মা বা আত্মীয়দের থেকে চার-পাঁচজনকে খরচ দিয়ে হজ করার জন্য পাঠিয়ে দেন। এভাবে কানিজ ফাতেমা নিঃশব্দে সমাজের সেবা করে যাচ্ছেন। তেমনি গত বছর রানা প্লাজা ধসে আহত বা পঙ্গু শ্রমিকদের বিশাল অঙ্কের সাহায্য হিসেবে নগদ টাকা প্রত্যেকের কাছে নিজ হাতে ঢাকা পঙ্গু হাসপাতাল ও সাভারে এনাম মেডিক্যালে গিয়ে দিয়েছেন; যাতে কেউ এ থেকে বঞ্চিত না হন।

 

নারীদের ব্যবসায়িক কাজে আত্মনিয়োগ প্রসঙ্গে তিনি জানান, ‘বাংলাদেশ উন্নয়নশীল একটি দেশ। এ দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই নারী। এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে ঘরে রেখে দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই প্রত্যেক পরিবারের বাবা, ভাই বা স্বামীর উচিত নারীকে তার মেধানুযায়ী কাজে আত্মনিয়োগ করতে সহযোগিতা করা। কারণ মেয়েদের একা পথ চলা এখনও কঠিন। তাদের মেধা আছে কিন্তু প্রয়োগের পথ প্রশস্ত নয়। এ দেশের পুরুষ যদি নারীকে নারী না ভেবে একজন দক্ষ মানুষ ভাবে তা হলে কাজ করাটা সহজ হয়ে যাবে। দেশ ও দশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। তিনি অত্যন্ত কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করলেন স্বামী ও মরহুম বাবার নাম। যারা তাকে এই পৃথিবীর পথে চলতে হাত ধরে শিখিয়েছেন কিভাবে একজন নারী তার যোগ্য স্থানটি পেতে পারে।

 

আগামী দিনের নারীদের উদ্দেশে তিনি বলেছেন যারা আজ ছোট, কাল তারা বড় হবে। সুতরাং বড় হওয়াতে শুধু নয়, জ্ঞানেগুণে, শিক্ষাদীক্ষায় একজন নারীকে প্রথমে নিজেকে তৈরি করতে হবে, তার পর সে তার যোগ্যতানুযায়ী একটু একটু করে এগিয়ে যাবে। হোক কারো অধীনে চাকরি অথবা উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ। সব কিছুই ধৈর্য ও ধীরস্থিরভাবে এগোতে হবে। নইলে উন্নতি করা যাবে না। তা ছাড়া ব্যবসায় করতে গেলে প্রথমে সাহস ও নিজের ওপর আস্থার প্রয়োজন। তার পর বুঝে শুনে পথ চলতে হবে।

 

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জানান,‘আমাদের গ্রামের বাড়ি মাগুরা। ওখানে দাদাজীর গড়া একটি স্কুল আছে, ওটাকে বড় হাইস্কুলে রূপান্তরিত করা এবং নোয়াখালী জালিয়াল গ্রামে আমার শ্বশুরবাড়ি, ওখানে শ্বশুর মরহুম গোলাম মোস্তফার নামে একটি হাইস্কুলও প্রতিষ্ঠা করার ইচ্ছে আছে। মাদরাসা-মসজিদ তো আগে করা হয়েছে। তার পর সমাজসেবামূলক একটি ট্রাস্টি বোর্ড থাকবে। এখানে সারা বছরের লভ্যাংশের কিছু অংশ জমা রাখা হবে আর আমাদের এই Max গ্রুপের সাথে যারা জড়িত যেমন ভাইবোন, ছেলেমেয়ে, আমি, আমার স্বামী, কর্মচারী ও কর্মকর্তারা ইচ্ছানুযায়ী যেকোনো সময় যেকোনো অঙ্কের দান নিঃশব্দে করতে পারেন। সবই জমা হবে Max গ্রুপের ফাউন্ডেশনের ট্রাস্টে। আর এই অর্থ প্রতি বছর কিছু মেধাবী এতিম ছাত্রছাত্রীর মধ্যে পড়াশোনা বাবদ বিতরণ করা হবে। একটি পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল করার ইচ্ছাও আছে। তবে ঠিক এখনই নয়, আরো কিছু দিন পর।

 

ভবিষ্যতে আরো নতুন কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খোলার ইচ্ছে আছে কি না,এ প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তিনি জানান, ‘বর্তমানে খাবারে এত বেশি ভেজাল আর এসব ভেজাল খাবার খেয়ে আমাদের নানা রকম অসুখ হচ্ছে,তাই আমি চাই ক্যামিক্যালমুক্ত ভালো ভালো কিছু দেশীয় ফলের জুস, ফ্রোজেন খাবার, দেশীয় খাবারের রেস্টুরেন্ট যেখানে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার পাওয়া যাবে যা খেয়ে অন্তত মানুষ সুস্থভাবে বাঁচতে পারবেন। এ রকমই কিছু নতুন ব্যবসায় নিয়ে মার্কেটে আত্মপ্রকাশ করার কথা ভাবছি আর আমার ছেলে জুলকার নাইন বছর কয়েক আগে আমেরিকার পারডু (Pardue) University থেকে বিবিএ শেষ করে পাশাপাশি গাড়ি তৈরির নানান প্রস্তুতিগত জ্ঞান, অত্যাধুনিক যন্ত্রাংশ, ফিটিংস সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করে এসেছে। তাই জুলকার নাইন চাইছে বাংলাদেশে নতুন প্রযুক্তি সংযুক্ত করে অল্প খরচে কী করে গাড়ি তৈরি করা যায় সেই রকম একটি শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠার। এই স্বপ্ন আমারও। তাই আমি ভবিষ্যৎ স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে চলেছি। মেয়ে আজরিন আলম Max Building Technologies Ltd. -এ আর্কিটেক্ট হিসেবে জয়েন্ট করেছে আজ এক বছর। তারও আমার মতো চিন্তা নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে কিভাবে নতুন নতুন ডিজাইনের অত্যাধুনিক সুবিধাসম্পন্ন বিল্ডিংয়ের ফ্যাট করে দেশের অবকাঠামোগত চেহারা বদলে সুন্দর পরিচ্ছন্ন শহর নির্মাণ করা যায়।

 

সব মিলিয়ে Max একটি গ্রুপ অব বিজনেস যেখানে আমার পরিবারের সবাই জড়িত। আমরা সবাই যার যার অবস্থান থেকে সুনিপুণভাবে দায়িত্ব পালন করে Max-কে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। এটি দেশ ও দশের কল্যাণে সব সময় কাজ করছে ও ভবিষ্যতে তা চালিয়ে যাবে এটিই আমার প্রত্যাশা।সূত্র: অনলাই

 

অপরাজিতাবিডিডটকম/আরএ/৫ফেব্রুয়ারী১৫৪০ঘন্টা২০১৪

Facebook Comments