banner

বুধবার, ১৪ মে ২০২৫ ইং, ,

পোস্টটি 19 বার পঠিত

 

পারিবারিক কলহের বলি হয়ে ঝরে গেলো একটি প্রাণ

 

চট্টগ্রামের র‍্যাব-৭ এর চান্দগাঁও ক্যাম্পের এক নির্জন অফিস কক্ষে সকালটা ছিল অন্যরকম নীরব। অফিসে ঢোকার সময় সহকর্মীরা হয়তো ভেবেছিলেন, প্রতিদিনের মতোই দায়িত্বে নিযুক্ত হবেন তাদের প্রাণচঞ্চল ও দায়িত্বশীল সহকর্মী এএসপি পলাশ সাহা। কিন্তু দরজা খুলতেই এক বিভীষিকাময় দৃশ্য তাদের চোখে পড়ে,রক্তে ভেজা ইউনিফর্মে পড়ে আছেন পলাশ সাহা, হাতে নিজের সার্ভিস রিভলভার।

একজন তরুণ, প্রতিশ্রুতিশীল পুলিশ অফিসার—যিনি রাষ্ট্রের সেবায় জীবন উৎসর্গ করতে শপথ নিয়েছিলেন, তিনিই কেন নিজেই নিজের জীবন কেড়ে নিলেন? মৃত্যুর আগে রেখে যাওয়া ছোট্ট একটি চিরকুট যেন সেই প্রশ্নের উত্তর দেয় “আমার মৃত্যুর জন্য মা ও বউ কেউ দায়ী না। আমিই দায়ী। কাউকে ভালো রাখতে পারলাম না।” কিন্তু এই একটি বাক্যে ঢাকা পড়েনি সেই গভীর পারিবারিক সংকট, যেটি ধীরে ধীরে পলাশকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়।

পলাশ সাহা ৩৭তম বিসিএসের মেধাবী র‍্যাব কর্মকর্তা। গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়ার সন্তান হিসেবে এলাকার গর্ব। সহকর্মীদের ভাষায়, তিনি ছিলেন দায়িত্ববান, দৃঢ়চেতা এবং বিনয়ী। তার এমন করুণ পরিণতি কারো কল্পনায়ও আসেনি।

পরিবার সূত্রে জানা যায়, দুই বছর আগে সুস্মিতা সাহার সঙ্গে পলাশের বিয়ে হয়। সেই সম্পর্কের শুরু থেকেই পলাশের মা আরতি সাহার সঙ্গে সুস্মিতার সম্পর্ক খারাপ ছিল। সময়ের সাথে সেই বিরোধ আরও তীব্র হয়ে উঠে। পলাশ চেষ্টা করেও মা এবং স্ত্রীর মধ্যে শান্তি আনতে পারেননি।

ফরিদপুরের চৌধুরীপাড়ায় পলাশের শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে জানা যায় এক বেদনাময় চিত্র। শ্বশুর ভরত সাহা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “আমার মেয়ে সুস্মিতাকে অনেক ভালোবাসত পলাশ। কিন্তু সেই ভালোবাসা তার মা সহ্য করতে পারেনি। মেয়েটা আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল কয়েকবার।” পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, বিয়ের পর থেকেই সুস্মিতা তার শাশুড়ি আরতি সাহার নির্যাতনের শিকার হন। রান্না নিয়ে অপমান, কথা বলা নিয়ে টিপ্পনি, এমনকি ফেসবুকে আত্মহত্যার ইঙ্গিতপূর্ণ পোস্ট দিয়েও পরে বাধ্য হয়ে তুলে নিতে হয় তাকে।

পলাশের স্ত্রী সুস্মিতা সাহা সংবাদমাধ্যমে জানান, শাশুড়ির চাপে তিনি স্বামীর সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়েই তুলতে পারেননি। পলাশ খুবই ভালো মানুষ কিন্তু ছিলেন মাত্রাতিরিক্ত মাতৃভক্ত। এমনকি ৩৫ বছর বয়সেও মা তাকে নিজ হাতে খাওয়াতেন, কোন পোশাক পরবে সেটাও মা ঠিক করতেন। বাড়ির সব সিদ্ধান্তে শাশুড়ির আধিপত্য ছিল। ফলে স্বামীকে ভালোবাসলেও, সুস্মিতা নিজেকে যেন ‘তৃতীয় ব্যক্তি’ বলে মনে করতেন সংসারে।
বিয়ের শুরুর দিকে সুস্মিতা চেষ্টা করেছিলেন সংসারটাকে গুছিয়ে রাখতে। শাশুড়ির চুলে তেল দেয়া থেকে শুরু করে গোসল করানো পর্যন্ত সব করেছেন। কিন্তু এত যত্ন-আদর সত্ত্বেও সম্পর্কের বরফ গলেনি। বরং দিনের পর দিন বাড়তে থাকে উপেক্ষা ও মানসিক অবহেলা।

সুস্মিতার চাচাতো ভাই পার্থ সাহাও অভিযোগ করেন, বিয়ের পর থেকে যৌতুকের জন্য চাপ ও নির্যাতন চলেছে। তবে পলাশকে সবসময় ভালো মনে হয়েছে।

এদিকে পলাশের আত্মহত্যার পর তার আত্মীয়রা সামাজিক মাধ্যমে স্ত্রীকে দায়ী করে নানা স্ট্যাটাস দিলেও সুস্মিতার দেওয়া তথ্যগুলো স্পষ্ট করে, এটি ছিল এক জটিল মানসিক দ্বন্দ্ব ও পারিবারিক একচ্ছত্র আধিপত্যের করুণ পরিণতি।

যদিও ঘটনাটিকে আপাতদৃষ্টিতে আত্মহত্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, অনেকের মনে প্রশ্ন উঠেছে: এটি কি নিছক আত্মহত্যা, নাকি মানসিক ও পারিবারিক নির্যাতনের প্ররোচনায় সংঘটিত আত্মহনন? বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৩০৬ ধারায় “আত্মহত্যায় প্ররোচনা” একটি অপরাধ হিসেবে স্বীকৃত। তবে সামাজিক রীতি অনুযায়ী পারিবারিক কলহকে প্রায়শই গোপন করা হয় কিংবা ‘গৃহস্থালির ব্যাপার’ বলে উড়িয়ে দেওয়া হয়।

এই ঘটনার ভেতরে লুকিয়ে আছে বৃহত্তর একটি প্রশ্ন—আমাদের সমাজে পারিবারিক সম্পর্ক কীভাবে একজন ব্যক্তিকে মানসিকভাবে ভেঙে দিতে পারে? বিবাহিত জীবনে স্বামী-স্ত্রী ও শ্বশুরবাড়ির মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে অসংখ্য মামলা-মোকদ্দমা আমাদের আদালতগুলোতে জমে থাকলেও সমস্যা প্রতিরোধে নেই কোনো কার্যকর সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় নীতি।

সমাজ, রাষ্ট্র এবং পরিবার তিনটি স্তরেই প্রয়োজন সচেতনতা, সহনশীলতা এবং সহানুভূতি। নইলে এমন পলাশদের আর শেষ নেই, শুধু সময়ের সাথে নামগুলোই পাল্টাবে।

তথ্যসূত্রঃপ্রথম আলো
যুগান্তর
চ্যানেল ২৪

Facebook Comments