banner

শুক্রবার, ০২ মে ২০২৫ ইং, ,

পোস্টটি 15 বার পঠিত

 

নারী ও পুরুষের মাঝে মর্যাদায় সমতা, কিন্তু দায়িত্ব ও কর্মক্ষেত্রে ন্যায্যতা — এটাই ইসলামের নীতি

আঁখি ফেরদৌসী: একটি দেশের জনগণের জন্য যে কোন ধরনের নীতিমালা প্রণয়নে কোন বিষয়টি সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পাবে ? যে বিষয়টি প্রাধান্য পাবে তাহলো জনগণের মৌলিক অধিকার ও কল্যাণ।সে দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট,ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধের সম্মান,সংবিধান ও আইনি কাঠামো যাতে করে সেই মূলনীতির মাধ্যমে যাদের জন‍্য মূলনীতি প্রনয়ন করা হয়েছে তাদের সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত করা যায়।

এবার আসা যাক আলোচিত নারী বিষয়ক সংস্কার কমিটি কর্তৃক প্রস্তাবিত নারী নীতিমালার বিষয়ে-
একদম শুরুতেই এই নীতিমালার লক্ষ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে-
‘‍সর্বক্ষেত্রে সর্বস্তরে নারীর প্রতি বৈষম বিলুপ্তি এবং নারী পুরুষের সমতা অর্জনের লক্ষ্যে পদক্ষেপ চিহ্নিতকরণ’
অর্থাৎ তাদের মূল ফোকাস নারী পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রে সমতা ।
সংক্ষেপে বললে:
‘সমতা’ মানে সবাইকে সব দিক থেকে একরকম করে দেওয়া।
‘ন্যায্যতা’ মানে যার যা প্রাপ্য, উপযোগী এবং যথার্থ — সেই অনুযায়ী অধিকার ও দায়িত্ব দেওয়া।
মানুষ হিসেবে মানবিক অধিকার আর সামাজিক বা নাগরিক অধিকারের ক্ষেত্রে ইসলামও সমতার কথা বলে। যেমন-
শুরা আহযাবের ৩৫ নাম্বার আয়াতে বলা হয়েছে-
নিশ্চয় মুসলিম পুরুষ ও নারী, মুমিন পুরুষ ও নারী, অনুগত পুরুষ ও নারী, সত্যবাদী পুরুষ ও নারী, ধৈর্যশীল পুরুষ ও নারী, বিনয়াবনত পুরুষ ও নারী, দানশীল পুরুষ ও নারী, সিয়ামপালনকারী পুরুষ ও নারী, নিজদের লজ্জাস্থানের হিফাযতকারী পুরুষ ও নারী, আল্লাহকে অধিক স্মরণকারী পুরুষ ও নারী, তাদের জন্য আল্লাহ মাগফিরাত ও মহান প্রতিদান প্রস্তুত রেখেছেন।’‍

সূরা নাহলের ৯৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে-

যে ব্যক্তিই মুমিন থাকা অবস্থায় সৎকর্ম করবে, সে পুরুষ হোক বা নারী, আমি অবশ্যই তাকে উত্তম জীবন যাপন করাব এবং তাদেরকে তাদের উৎকৃষ্ট কর্ম অনুযায়ী তাদের প্রতিদান অবশ্যই প্রদান করব।’

সূরা তওবা ৭১ নং এ বলা হয়েছে-

আর মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারী একে অপরের বন্ধু [১], তারা সৎকাজের নির্দেশ দেয় ও অসৎকাজে নিষেধ করে, সালাত কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে; তারাই, যাদেরকে আল্লাহ্‌ অচিরেই দয়া করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ্‌ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।

সূরা নিসার ১২৪ নং আয়াতে বলা হয়েছে-

আর যে ব্যক্তি সৎকাজ করবে, সে পুরুষ হোক বা নারী, যদি সে মুমিন হয়ে থাকে, তবে এরূপ লোক জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তাদের প্রতি সামান্য পরিমাণও জুলুম করা হবে না।

আরো বলা হয়েছে-

“পুরুষদের জন্য যা তারা উপার্জন করে তার প্রতিফল, আর নারীদের জন্যও যা তারা উপার্জন করে তার প্রতিফল।”
(সূরা আন-নিসা, ৪:৩২)

এই আয়াত গুলো থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে,মানুষ হিসেবে পুরুষ ও নারীর আল্লাহর কাছে সমান। তারা আল্লাহর কাছে সম্মানিত হবেন তাদের কাজের ভিত্তিতে, লিঙ্গের ভিত্তিতে নয়।
তাই ইসলামে যেমন সমতা (equality) গুরুত্ব রয়েছে আবার ন্যায্যতা (equity/justice)-কে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

মানে, ইসলামে নারী-পুরুষকে একই রকম সব দায়িত্ব বা অধিকার দেয়নি, বরং তাদের স্বভাব, যোগ্যতা এবং ভূমিকার উপর ভিত্তি করে ন্যায্য অধিকার ও দায়িত্ব বণ্টন করেছে।
যেমন-পুরুষদের উপর পরিবারের আর্থিক দায়িত্ব ও নারীদের রক্ষা ও সম্মান দেওয়া দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এটা সমতার বদলে ন্যায্যতার উদাহরণ। কারণ নারী ও পুরুষের স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য এক নয়, তাই তাদের দায়িত্বও স্বাভাবিকভাবেই ভিন্ন।

কুরআনে আল্লাহ বলেছেন:
“নারী শ্রমিকের শ্রম কখনো বিনষ্ট করি না; তোমরা একে অপরের অংশ।”
(সূরা আলে ইমরান, ৩:১৯৫)

আরো বলেছেন-
“পুরুষরা নারীদের উপর দায়িত্বশীল, কারণ আল্লাহ তাদের একের ওপর অপরের বৈশিষ্ট্য দিয়েছেন এবং তারা তাদের অর্থ দিয়ে তাদের রক্ষা করে।”
(সূরা আন-নিসা, ৪:৩৪)
এখানে বোঝানো হয়েছে, পুরুষের উপর পরিবারের নেতৃত্ব ও দায়িত্ব আর্থিক ও শারীরিকভাবে বেশি। নারীর দায়িত্ব প্রধানত পরিবারকে ভালোভাবে রক্ষা করা ও সহযোগিতা করা। এখানে সমতা নয়, বরং ন্যায্যতার নীতি অনুসরণ করা হয়েছে।

ইসলামে ন্যায্যতার নীতি বাস্তব জীবনে কিভাবে প্রয়োগ হয়েছে তা দেখা যাক-

১. খাদিজা (রা.) মহানবী (সা.)-এর প্রথম স্ত্রী, নিজে একজন সফল ব্যবসায়ী ছিলেন।
তিনি ব্যবসার মাধ্যমে আর্থিকভাবে নিজেকে এবং নবীজি (সা.)-কেও সহযোগিতা করেছেন।
কিন্তু তাঁর উপর পরিবার চালানোর পুরুষের দায়িত্ব চাপানো হয়নি। বরং স্বেচ্ছায় সহযোগিতা করেছেন।
তার মানে নারী চাইলে ব্যবসা করতে পারে, কিন্তু পরিবারের ভরণপোষণের মূল দায়িত্ব পুরুষের — এটি ইসলামের ন্যায্যতার নীতি।

২.ফাতিমা (রা.) ঘরের কাজ করতেন, সন্তানদের দেখাশোনা করতেন, এবং ধর্মীয় অনুশাসনে জীবন পরিচালনা করতেন।
স্বামী হযরত আলী (রা.) ঘরের বাইরের কাজ করতেন এবং আর্থিক দায়িত্ব বহন করতেন।
যখন ফাতিমা (রা.) গৃহকর্মে কষ্ট পেতেন, তখন নবীজি (সা.) তাঁকে ধৈর্য ধারণের এবং তাসবীহ তাহলীলের শিক্ষা দিয়েছেন।
অর্থাৎ নারীর আসল দায়িত্ব পরিবার পরিচালনা করা — কিন্তু এটি দাসত্ব নয়, বরং মর্যাদার কাজ তা তুলে ধরা হয়েছে।

৩. উম্মে সালামা (রা.) হুদাইবিয়ার সন্ধি চলাকালে নবীজি (সা.) মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন, তখন উম্মে সালামা (রা.) গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়েছিলেন, যেটা নবীজি (সা.) মেনে নেন।
তাঁর বুদ্ধিমত্তা পুরো মুসলিম উম্মাহকে কঠিন পরিস্থিতি থেকে বাঁচিয়েছিল। এ ঘটনা থেকে এটাই বুঝা যায় ইসলাম নারীর বুদ্ধিমত্তাকে সম্মান করে এবং প্রয়োজনে রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক পরামর্শে নারীর অংশগ্রহণকে স্বীকৃতি দেয়।
৪. হযরত নুসাইবা বিনতে কা’ব (রা.) — উহুদের যুদ্ধে তিনি নবীজি (সা.)-কে রক্ষা করতে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছিলেন।
যদিও নারীদের উপর যুদ্ধ ফরজ ছিল না, তবুও প্রয়োজনে ইসলাম নারীদের সম্মানজনক ভূমিকা রাখতে অনুমতি দিয়েছে।

ইসলাম ন্যায্যতার ভিত্তিতে দায়িত্ব ভাগ করেছে, তবে চরম প্রয়োজনে নারীও সম্মানজনক অবস্থানে থাকতে পারে বলেও স্বীকৃতি দিয়েছে।ন‍্যায‍্যতার ভিত্তিতে দায়িত্বের বন্টন মানে এই নয় যে ইসলামে নারীকে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে বরং তার যোগ্যতা, প্রয়োজন ও স্বভাবের ভিত্তিতে ন্যায্য ও মর্যাদাপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

আমাদের মনে রাখতে হবে বাস্তবে নারী ও পুরুষ পরস্পরের পরিপূরক (complementary), প্রতিদ্বন্দ্বী (competitive) নয়।

Facebook Comments