সম্প্রতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গঠিত ‘নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন’ ১৫টি সুপারিশ জমা দিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার নিকট, যার মধ্যে কয়েকটি সুপারিশ দেশব্যাপী তীব্র বিতর্ক ও প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে।
কমিশনের দাবি, তারা সংবিধান, আইন ও নারীর অধিকারের ভিত্তিতে সমতা নিশ্চিত করতে এসব সুপারিশ প্রণয়ন করেছে। তবে বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক সংগঠন এই সুপারিশকে ইসলামবিরোধী ও সমাজবিধ্বংসী আখ্যা দিয়ে প্রত্যাখ্যান করেছে।
সবচেয়ে বিতর্কিত সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে মুসলিম উত্তরাধিকার আইন পরিবর্তন করে নারী-পুরুষের সম্পত্তিতে সমান অধিকার নিশ্চিত করা, অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়ন, এবং সিডও (CEDAW) সনদের বিতর্কিত ধারাগুলোর সংরক্ষণ প্রত্যাহার,যা মূলত ইসলামী বিধানকে অগ্রাহ্য করে পশ্চিমা নারীবাদী নীতি চাপিয়ে দেওয়ার গভীর ষড়যন্ত্র।
পতিতাবৃত্তিকে ‘শ্রমজীবী পেশা’ হিসেবে স্বীকৃতি, সংসদে ৩০০ নারী আসন সংরক্ষণ এবং ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’-কে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাবও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, এসব সুপারিশ সমাজে পারিবারিক সম্পর্ককে দ্বন্দ্বের দৃষ্টিতে দেখার প্রবণতাকে উস্কে দিতে পারে, যা বাঙালি সমাজে প্রচলিত পারস্পরিক নির্ভরতা ও সহমর্মিতাকে বিপন্ন করবে।
ধর্মীয় নেতাদের মতে, এসব সুপারিশ ইসলামী শরিয়াহ ও সংবিধানে সুরক্ষিত ধর্মীয় স্বাধীনতার পরিপন্থী। হেফাজতে ইসলাম ও জামায়াতে ইসলামি উভয়েই এ প্রস্তাবনায় ঘোর আপত্তি জানিয়েছে। হেফাজত কমিশন বাতিলের দাবি জানিয়ে ৩ মে পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে, অন্যদিকে জামায়াত এই প্রতিবেদনকে ‘গর্হিত’ আখ্যা দিয়ে তা প্রত্যাখ্যান করেছে।
ছাত্রী সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রী সংস্থার পক্ষ থেকে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি প্রকাশ করে বলে ”সম্প্রতি নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে সরকারের নিকট যে প্রতিবেদন ও সুপারিশমালা জমা দেওয়া হয়েছে, তা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ধর্মীয় বিশ্বাস, পারিবারিক মূল্যবোধ এবং ঐতিহ্যের ওপর সরাসরি আঘাত হানে। এটি নারী উন্নয়নের নামে একটি মতাদর্শিক ও পশ্চিম-অনুকরণভিত্তিক আগ্রাসন ছাড়া কিছুই নয়।”
ধর্মীয় ও সামাজিক সংগঠনগুলো অভিযোগ তুলছে, কমিশনের সদস্যরা মূলধারার নারীদের প্রতিনিধিত্ব করেন না এবং এই সুপারিশসমূহ গবেষণার ভিত্তিতে নয় বরং একপেশে মতাদর্শিক অবস্থান থেকে করা হয়েছে। ‘নারীপক্ষ’-এর নেতৃত্বে গঠিত এই কমিশনের সুপারিশগুলোকে পশ্চিমা নারীবাদী ভাবধারার অনুকরণ হিসেবে বিবেচনা করছেন সমালোচকরা।
অন্যদিকে, প্রধান উপদেষ্টা এসব সুপারিশকে সময়োপযোগী উল্লেখ করে এগুলো লিফলেট ও বই আকারে প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছেন। তবে বিশ্লেষক মহল মনে করছে, এমন সংবেদনশীল ও ধর্মীয় মূল্যবোধ-সম্পর্কিত বিষয়ে সামাজিক ঐকমত্য ছাড়া সিদ্ধান্ত গ্রহণ অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে।
বাংলাদেশে নারী অধিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হলেও, তা বাস্তব ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে নয়—এমনটাই প্রত্যাশা দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর। নারী উন্নয়নের নামে যদি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ও সামাজিক কাঠামোতে বিচ্যুতি তৈরি হয়, তবে তা প্রত্যাশিত অগ্রগতির বিপরীতেই গড়াতে পারে।